শরীফ সাথী

  ২৭ জুন, ২০২০

বৃক্ষ ও পাখি

রোদের তেজ হালকা হতে শুরু করেছে। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে, মেলে আছে, প্রদ্বীপ হাতে আলোকসজ্জায় সাজাতে। বিকালের এমন আবহাওয়াটায় গা এলিয়ে বসলে, দখিনা বাতাস শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেন কিছু বলে যায়। ঠিক এমন মুহূর্তে পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে সাহিত্যর খুব ভালো লাগে ঘরের ছাদে উঠে বসে খেলতে। তার খেলার নিদারুণ বৈচিত্র্যতা সবাইকে আকৃষ্ট করার মতো। পাকা পাকা লালচে হলুদে মাখা কুলগুলো নেটের জালে জড়িয়ে, রোদ মুখো ছড়িয়ে, মা রোদে শুকাতে দিয়েছে। শুকিয়ে গেলে ভালো মানের আচার’ বানানোর জন্য। একবার আচার বানালে গুড়, চিনি অথবা খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে, সারা বছর মজায় মজায় খাওয়া যায় চাটনি করে। ঘরের ছাদের ওপরের এক কোণে নুইয়ে এসেছে, ঘরের পাশে অবস্থিত আমগাছের সবুজ পাতায় ছাওয়া একটি বিশাল বড় ডাল। যে ডাল বেয়ে কাঠবিড়ালির দল ছাদে আসে। সারাক্ষণ নানা পাখি সমাবেশ করে।

কাঠবিড়ালি বিকালে এলে একটু আধটু কিছু খেতে পারে। ছাদে বসে রোজ বিকালে সাহিত্য থাকে যে। নেটের জাল আগলা করে সাহিত্য বসে আছে। কাঠবিড়ালি এসে একেকটি শুকানো কুল নেয় আর, সামনের পা দুটো হাত বানিয়ে কুর কুর করে মুখে তুলে খাওয়ার দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ লাগে সাহিত্যর। যে দৃশ্য বিশ্ব চোখে অম্লান। প্রতিদিন কিছু না কিছু এভাবে খেতে দেখতে সাহিত্যের খুব ভালো লাগে।

মায়াবী পরিবেশ মধুর আবেশ মিশ্রিত চোখের ছোঁয়ায় মনের আল্পনায় আঁকা ছবি মুহূর্তে ভালো লাগার অনুভূতি ভালোবাসার মহনায় আটকে পড়ে।

সাঁঝবেলায় মা এসে নেটে জড়ানো কুলগুলো তুলে নিয়ে যায়। কুল অল্প হয়ে যাওয়ায় সাহিত্যকে বকা দেয় কুল ছুড়েছিস নাকি বাইরে? সাহিত্য নীরব থাকে অপলকে। হারিয়ে যায় আবার সেই কাঠবিড়ালির খাওয়ার দৃশ্যে। কুল শুকানো, আম শুকানো, ধান শুকানো, গম শুকানো, ছোলা-মসুর-খেসারি-মুগ শুকানো, কলাই, ভুট্টা, সরিষা শুকানো, হরেক রকমের ডাল প্রায় প্রতিদিনই ছাদের ওপর শুকাতে দেওয়া থাকে। নিজেদের কিংবা মহল্লার কারো না কারো।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা খাদ্যকণাগুলো বিভিন্ন পাখিও এসে খায়। চড়–ই, শালিক, দোয়েল, কোয়েল, টুনটুনি, ঘুঘু প্রভৃতি দারুণ দারুণ পাখি আসে খেতে। মাঝে মাঝে কাকের দল হামাল বসায়।

দোয়েলের শিষ বাজানো, শালিকের কিচিরমিচির, ঘুঘুর ঘুঘু ডাকা, কবুতরের বাকবাকুম ডাকা আর ছাদের ওই ওপরে উড়ে উড়ে বাজি মারা (ডিগবাজি খাওয়া), টুনটুনির গুনগুনিয়ে ছন্দময় নাচা আর গান, প্রাণ জুড়ায় সাহিত্যর।

সাহিত্য সদনের তিনতলা বাড়ির ছাদে মায়াময় বৈচিত্র্যতায় গড়া চতুর্পাশে নিদারুণ ছোঁয়ায় প্রকৃতি মেলে আছে ‘সবুজ হাসি মুখ’। সাহিত্যর মা প্রতিদিনই সাহিত্যকে ছাদের ওপর খাবার খাওয়ায়। পাখি দেখায়, ফুল দেখায়, দেখায় চারপাশের কিছু না কিছু আর এক গাল ভাত তুলে দেয় মুখে।

রোজ বিকালে ছাদের ওপর ভারি মিষ্টি পরিবেশ। পাখির দল, কাঠবিড়ালি ও সাহিত্যর মজাদার আনন্দঘন মুহূর্ত আবেগে আবেগে আকুল করা, পাগল করা।

বিকালের সময়টুকু খুব ভালো কাটে সাহিত্যর। ছাদের চারদিকের সবুজ সমারোহে ছাওয়া অম্লান প্রকৃতির নিদারুণ চাওয়া, নির্মল হাওয়ায় একাকার। দুচোখে অনায়াসে আসে নানা ছবির মহরতের উৎসব। ঘটে নতুন কিছু স্বর্ণালি স্বপ্ন পাওয়ার প্রত্যাশা।

পাখিদের মিলনমেলা অবাধে হয় প্রতিদিনের প্রতিক্ষণে। নিজ মুখে খড়কুটো এনে পাখিদের বাসা বুনানো গাছের ডালে দেখতে কার না ভালো লাগে! সে দেখার চোখ দুটো যদি দুষ্টু ছোট্ট ছেলে সাহিত্যর হয়। তাহলে তো ভালো কিছু মায়া ভরে দেখা। পাখিদের বারবার ছোটাছুটি। একেকটি খড় এনে হরদম বাসা গোছানো বুনানো। থেকে থেকে মনে হয় ওদের ও সুন্দর মন আছে। চোখের মানান আছে। প্রতিটি বাসা তো ঠোঁট দিয়ে ভালোয় বানায়। নজর সরানো যায় না। নিজেদের তৈরি বাসায় ডিম পাড়ে। সে ডিম পাহারা দেওয়া, তাওয়া দেওয়া, বাচ্চা ফোটানো। খড়ের বাসায় ছানাগুলোর কিচিরমিচির মনোমুগ্ধকর ছন্দময আওয়াজ ভালো লাগার প্রেক্ষাপট। আবার খাবার অন্বেষণে ব্যস্ত পাখি। পোকা ধরে, শস্য কণা এনে মুখে মুখে ছানাগুলোর খাওয়ানো যে দেখার দেখেও, ওই দেখার শেষ হয় না। এমন মধুময় ভালো লাগা ছেড়ে, ভালোবাসা ছেড়ে সাহিত্যর যেন বিকালটায় অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না।

সবেমাত্র নতুন সোনালি আঁশ (পাট) উঠেছে। শুকানো পাটখড়িগুলো আমতলায় বড় মাচা করে সুন্দর করে গাদা দিয়ে রাখা। কাঠবিড়ালি দলের হরদম দৌড়াদৌড়ি আর ডাকাডাকি দেখে সাহিত্যর দুচোখ আটকা পড়ল পাটখড়ির গাদার কাছে। সে কী? অবাকময় দৃশ্য...

কাঠবিড়ালি পাটকড়িতে লেগে থাকা পাটের ফেসোগুলো মুখ এবং সামনের পা দিয়ে টেনে গুরগুরগুর গোলা করে মুখে ধরে আমগাছের ডাল বেয়ে ওই মগডালের কোণে বোনে বাসা আবার কেউ কেউ পাশে অবস্থিত বাঁশঝাড়ের মাঝের ঝাঁকালো গিটটায় বাসা বুননে ব্যস্ত। পাটের ফেসোগুলো খুব যতন করে, সুন্দর করে দেখার মতো বাসা বুনানো কাঠবিড়ালিদের নিজস্ব বিচিত্রময় কারুকাজ।

এসব মায়াময় সৌন্দর্য দেখে দেখে সাহিত্য যেন মমতার বন্ধনে আটকে ওদের সবাইকে বন্ধুত্ব করে নিল। দিন ক্ষণ মাস যায়... চোখে যেন আনন্দেরই চাষ হয়।

নতুন বছর এলো। পহেলা বৈশাখ। হইহুল্লোড়, আনন্দ, পাড়া-মহল্লায়, গ্রাম জেলা দেশজুড়ে একাকার। খাওয়া-দাওয়া ভালোয় হলো। মিষ্টি মুখ, কত রকমের ভোজন সেরে সপ্তাহ কাটল সাহিত্যর।

সেদিন ছিল বৈকালি আবহাওয়া। গ্রীষ্মের হঠাৎ ঘনকালো মেঘে পুরো আকাশ ছেয়ে গেল। সাহিত্য ঘরের ছাদেই ছিল। শমশম করে প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি সঙ্গে দমকা ঝড় ও বজ্রপাতের আগমনে হঠাৎ যেন এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। হঠাৎ করে ছাদের পাশে হেলানো আমগাছের সেই সবুজ পাতায় ছাওয়া ডালটি ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল। চারদিকে ফাঁকা শুধু ফাঁকা হয়ে গেল। পাখির দল, কাঠবিড়ালির দল যে কোথা গেল, সেদিনের সেই ভয়ংকর ঝড়ে?

এখানে আর আগের মতো আবেগ নেই! নেই সেই মায়াময় অনুভূতি, মধুর প্রকৃতি। আমগাছের পাশেই অবস্থিত জামগাছ বেয়ে আসার স্বপ্নটুকুও ম্লান। কারণ জামগাছটি মাজা বরাবর ভেঙে পড়ে গেছে।

সাহিত্যর আজ বৈকালি হাওয়ায় ছাদের ওপর একাকী শূন্য লাগে। ভালো লাগে না। ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য অংশটুকু শুধুই স্মৃতি মনে হয়। নেই আর এখানে কাঠবিড়ালি, পাখিদের আনাগোনা কোলাহল। ভালো লাগার সেসব দৃশ্য আজ সবই স্মৃতি। ছাদে উঠে এলে, চাইলে দৃষ্টি মেলে ছোট্ট ছেলে সাহিত্যর এক বুক সীমাহীন কচি মনে হারানোর ব্যথা-বেদনার কষ্টে, রক্তে দানা বাঁধা স্বপ্নময় মেঘ জমে, চোখের কোণে, ফোঁটা ফোঁটা জল বেয়ে নামে...।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close