এক জঙ্গলে বাস করত এক বাঘ। বাঘটি ছিল ভীষণ অহঙ্কারী আর হিংস্র। বনের পশুপাখিদের ধরে ধরে খেত। তাই বনের পশুপাখিরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকত। কারো মুখে কোনো হাসি ছিল না। সবাই মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে থাকত। আর মনে মনে মৃত্যুর প্রহর গুনত। না জানি বাঘ এসে কখন তাকে ধরে খেয়ে ফেলে।

একদিন সেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল এক শেয়াল। পথে দেখা হলো বানরের সঙ্গে। বানর বলল, গান বন্ধ করো ভাই। এই বনে গান গাওয়া যায় না। শেয়াল অবাক হয়ে বলল, কেন? এই জঙ্গলে এক অত্যাচারী বাঘ আছে। তার কানে গানের আওয়াজ গেলে তোমাকে ধরে খেয়ে ফেলবে।

বানরের কথা ভ্রƒক্ষেপ করল না শেয়াল। সে আগের মতো গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে লেজ নাচাতে নাচাতে সামনে এগোতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে দেখা হলো টিয়ের সঙ্গে। টিয়ে বলল, এই জঙ্গলে গান ধরো না ভাই।

শেয়াল বলল, কেন? টিয়ে বানরের মতোই বলল, এই জঙ্গলে এক অত্যাচারী বাঘ আছে। সে তোমার গানের আওয়াজ শুনতে পেলে তোমাকে খেয়ে ফেলবে। পরপর দুজন একই কথা বলাতে শেয়ালের মনে ধরল। সে একটু থেমে দেখল, সত্যিই তো, এই জঙ্গলে কোনো পশু লাফালাফি করে না, দৌড়ঝাঁপ করে না। পাখিরা গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে না। গান গায় না। সবকিছুই কেমন শুনশান আর নীরবতা। চালাক শেয়াল বুঝতে পারল, নিশ্চয় এই জঙ্গলে অত্যচারী বাঘ আছে। সে চিন্তা করল অত্যচারী এই বাঘকে কীভাবে সাজা দেওয়া যায়? হঠাৎ তার চোখে পড়ল সামনে একটা কূপ। কূপ দেখে তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। সে টিয়েকে বলল, বাঘ কোথায় থাকে? শুনেই তো টিয়ের গলা শুকিয়ে গেল। বড় একটা ঢোক গিলল। বলল, কেন? আমি তার কাছে যাব। বলো কি! কাছে গেলেই তো তোমাকে খেয়ে ফেলবে। সেটা আমি দেখব। টিয়ে শেয়ালকে বাঘের আস্তানা দেখিয়ে দিল। বলল, সামনের অই গোলপাতার মধ্যেই আছে বাঘ।

শেয়াল ধীরে ধীরে গোলপাতার ঝোপের কাছে গেল। ঝোপের কাছে গিয়ে রাস্তায় বসে হু হু করে কাঁদতে লাগল। শেয়ালের কান্না শুনে বাঘ ঝোঁপের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। শেয়ালকে রাস্তায় বসে কাঁদতে দেখে হুঙ্কার ছেড়ে বাঘ বলল, এই শেয়াল, তোমার এত বড় সাহস! আমার বাড়ির সামনে বসে কাঁদছ? শেয়াল বলল, কাঁদছি কী আর সাধে, মামা? কাঁদছি তোমার দুঃখের কথা ভেবেই। বাঘ হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বলতে চাও তুমি? স্পষ্ট করে বলো। শেয়াল বলল, তুমি আমাদের রাজা। তুমি আমাদের খাও, যেমন খুশি তেমন করো। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কী? কোথা থেকে এক বাঘ এসেছে এই জঙ্গলে। এসে বলছে তিনিই এখন এই জঙ্গেলের রাজা। এখন থেকে তিনিই আমাদের ধরে ধরে খাবে। শুনে তো বাঘ রেগেমেগে একাকার। হুঙ্কার দিয়ে বলল, কোথায় সে বাঘ? আমার রাজ্যে এসে এত বড় কথা? শেয়াল বলল, সে জঙ্গলের মুখে এক কূপে বসে আছে। চলো দেখি। শেয়াল বাঘকে কূপের কাছে নিয়ে গেল। বাঘ চারদিকে তাকিয়ে বলল, কই, আমি তো আশপাশে বাঘকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় বাঘ? শেয়াল বলল, মামা, সত্যিই তুমি এখনো বোকাই থেকে গেলে। শত্রু কি কখনো সামনাসামনি দাঁড়িয়ে থাকে? তবে? অই কূপের ভেতর লুকিয়ে আছে। বাঘ একলাফে চলে গেল কূপের কাছে। কূপটি ছিল অনেক গভীর এবং পানিতে ভর্তি। কূপের কাছে দাঁড়িয়ে বাঘ তাকাল পানির নিচে। ওমা! শেয়ালের কথা তো একেবারে সত্যি! পানির নিচে দাঁড়িয়ে আছে মস্তবড় এক বাঘ। পানির নিচে বাঘকে দেখে বাঘ তো একেবারে রেগেমেগে আগুন। হুঙ্কার দিয়ে বলল, কে তুমি? সঙ্গে সঙ্গে পানির নিচের বাঘটাও হুঙ্কার দিয়ে বলল, কে তুমি? কী? এত বড় সাহস? আমার মুখে মুখে তর্ক? সঙ্গে সঙ্গে পানির নিচের বাঘটাও বলল, কী? এত বড় সাহস? আমার মুখে মুখে তর্ক? বাঘ রাগে কাঁপতে লাগল। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। এই বলে কূপের মধ্যে দিল এক ঝাঁপ। কূপের ভেতরে আসলে কোনো বাঘ ছিল না। বাঘ কূপের পানিতে নিজের প্রতিবিম্বই দেখতে পাচ্ছিল। বোকা বাঘ কিছু বুঝতে না পেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং হাবুডুবু খেয়ে মারা গেল। জঙ্গলের পশুপাখিরা খুব খুশি হলো। তাদের মনে আর কোনো ভয় রইল না। মহা-আনন্দে তারা জঙ্গলে বসবাস করতে লাগল।

"