রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৫ মার্চ, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

করোনার এপিসেন্টার এখন ইউরোপ

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনা রোগটির নতুন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপ। চীনকে বাদ দিলে সারা বিশ্বে যত নতুন রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ইউরোপে। দ্য ওয়াল ব্যুরো করোনাভাইরাসকে মহামারি হিসেবে আগেই ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এবার তারা জানিয়েছে ইউরোপ এই নভেল করোনাভাইরাসের এপিসেন্টার হয়ে উঠেছে। এক সংবাদ সম্মেলনে হু-এর প্রধান টেডরোস জানিয়েছেন, বর্তমানে এই প্যানডেমিক বা মহামারি এপিসেন্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপ। টেডরোসের কথায়, চীনের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইউরোপেই সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যাও। তিনি বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায়, এমনকি চীনের থেকেও বেশি হারে এখন ইউরোপে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা মিলছে প্রতিদিন। গত ডিসেম্বরে প্রথম শোনা গিয়েছিল নভেল করোনাভাইরাসের নাম। চীনের উহান শহর ছিল এই ভাইরাসের প্রাথমিক উৎসস্থল। এরপর ধীরে ধীরে এই ভাইরাস ত্রাস সৃষ্টি করেছে বিশ্বজুড়ে। বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। মহামারির আকার নিয়েছে করোনাভাইরাস। এএফপির একটি সমীক্ষা অনুসারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ইতোমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার জনের। সারা পৃথিবীতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩৪ হাজার। হু-এর প্রধান টেডরোসের কথায়, করোনাভাইরাসের জেরে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজারে পৌঁছে যাওয়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুঃখজনক, হতাশার এবং ভয়েরও।

এমনকি ভবিষ্যতে এই মহামারির গতিপ্রকৃতি কেমন হবে; সেটা যে একেবারেই আগে থেকে অনুমান করা যাবে না সে কথা জানিয়েছেন হু-এর ইমার্জেন্সি ডিজিজ ইউনিটের প্রধান মারিয়া ভ্যান কেরখোভে। তার কথায়, সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস যে কী আকার নেবে, সেটা বলা সত্যিই মুশকিল। হয়তো এর প্রভাবে অবস্থা আরো ভয়ানক হতে চলেছে। কিন্তু সেটা কবে হতে পারে; সে ব্যাপারে কোনো আগাম সতর্কতা দেওয়া সম্ভব নয়। চীনের উহান শহরের পর করোনাভাইরাস ক্রমেই ছড়িয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ইতালি, ফ্রান্স ছাড়াও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও পাওয়া আক্রান্ত এবং মৃতের খবর। এ ছাড়াও ইরান-দক্ষিণ কোরিয়া-ভারতসহ একাধিক দেশে থাবা বসিয়েছে এই নভেল করোনাভাইরাস। হু-এর প্রধান টেডরোসের কথায়, নির্দিষ্ট দেশে কোনো মহামারি বা রোগের ভয়াবহ রূপ দেখলেও অনেক সময় মনে করা হয় আরেকটি দেশে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমন ভাবনাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই এখন উচিত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ভাইরাস আক্রান্তকে খুঁজে বের করা, তার সঠিক চিকিৎসা করা। কোয়ারেন্টাইন করা এবং আইসোলেশনে রেখে পর্যবেক্ষণ করাÑ এসব কাজ একই সঙ্গে করতে হবে। অর্থাৎ খুঁজে বের করা, চিকিৎসা করা এবং ভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দেওয়ার চেষ্টা সব একসঙ্গেই করা প্রয়োজন। কোনো একটা কাজে ফাঁক থাকলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা থাকবে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, ইউরোপ করোনাভাইরাস মহামারির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাওয়া একটি করুণ মাইলফলক। চীনের পর করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ইউরোপের দেশগুলোকে। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা দেয়। পুরো ইউরোপ এখন লাল। করোনা সংক্রমণের মানচিত্রে পুরো লাল হয়ে গেছে ইউরোপ। সব স্থানেই স্পর্শ করেছে ভয়াবহ এই ভাইরাস। এতে শুধু ইতালিতে মারা গেছে ৪৮২৫ জন। সেখানে সারা দেশে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। করোনা সংক্রমণ হয়েছে সদ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্রিটেনে। ইউরোপের দেশ জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন। সব স্থানেই করোনা সংক্রমণ হওয়ায় ভয়াবহ এক অবস্থা বিরাজ করছে। তার চেয়ে বড় কথা, এসব দেশে বা ইউরোপে বসবাস করেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ। তাদের মধ্যেও এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্রিটেন ও ইউরোপের অবস্থা বোঝাতে যে মানচিত্র দেখানো হয়েছে, তাতে পুরো মানচিত্রই লাল হয়ে আছে। এ ছাড়া গোটা বিশ্বে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করেছে। ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ইউরোপের অনেক দেশে। সিএনএন ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

চীনের পর ভাইরাসটিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত ইউরোপের দেশ ইতালিতে। চলমান পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে পুরো ইতালিতে ভ্রমণ ও জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ৩ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটির সব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে খেলাসহ অন্যান্য কর্মসূচি। এ ছাড়া ফার্মাসি ও খাবারের দোকান ছাড়া অন্য সব ধরনের দোকানও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ও এক সংসদ সদস্যও আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। চলমান পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে জনসমাগম নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। এ ছাড়া বাতিল করা হয়েছে খেলা, কনসার্টসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জেরে আগামী ৩০ দিনের জন্য ইউরোপের ২৬ দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ স্থগিত করা হয়েছে; যা কার্যকর হবে আগামীকাল মধ্যরাত থেকে। তবে যুক্তরাজ্য এর আওতায় থাকছে না। গতকাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। ইউরোপে ইতালির পর স্পেনেই সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। স্পেনের সরকার ঘোষণা করেছে, খাদ্য ও ওষুধ কেনা এবং চিকিৎসা ও জরুরি কাজ ছাড়া আগামী ১৫ দিন সব মানুষকে নিজ ঘরেই অবস্থান করতে হবে। ইতোমধ্যেই দেশটিতে ৬২৫১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১৯৩ জন। ফ্রান্সে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ৯১ জনের। এ ছাড়া প্রতিদিনই মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

তাই দেশটিতেও ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল এবং বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বিমান, ট্রেন এবং বাস চলাচলও রোববার থেকে কমিয়ে আনা হবে। অস্ট্রিয়ার সরকার বলেছে, জনগণের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত করে আনা হবে। পাশপাশি কম প্রয়োজনীয় দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, বার, খেলার মাঠ এবং ক্রীড়া ভেন্যুগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ড থেকে তাদের দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। এর আগে ইতালিসহ আরো বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে আমেরিকা। যুক্তরাজ্যও এখন থেকে খুব জরুরি দরকার ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে না যেতে পরামর্শ দিচ্ছে।

ডিসেম্বরের শেষে চীনে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বিশ্বকেও আর এক দিনে এত মৃত্যু আরো কোনো দিন দেখতে হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের অনেক দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। চলাফেরায় বিধিনিষেধ, ভ্রমণ সতর্কতা, বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার বাধ্যবাধকতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার মধ্যে দেশে দেশে জনজীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। যুক্তরাজ্যে যাদের বয়স ৭০ বছরের বেশি, তাদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছে, কারণ বয়স্করাই এ ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ও লুক্সেমবুর্গের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানি। পর্তুগাল বন্ধ করেছে স্পেনের সঙ্গে সীমান্ত।

এমনকি নাগরিকদের চলাফেরায় বিধিনিষেধ দিয়েছে চেক রিপাবলিকও। সেখানে খাবার, ওষুধের মতো জরুরি জিনিসপত্র কেনা এবং পেশাগত কারণ ছাড়া বাইরে বের হওয়া মানা। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। আয়ারল্যান্ডের সব ২৯ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বে চীনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে ইতালি। জেনেভায় সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, নভেল করোনাভাইরাসে ১৪৭ দেশে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার মানুষ, প্রাণ গেছে ১০ হাজার ৭২০ জনের। এরপর ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য এলাকা থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর যেসব খবর এসেছে, তা সমন্বয় করে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৬৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১০ হাজার। চীনের বাইরে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে বলে হিসাব দিচ্ছেন জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এই হিসাব ঠিক থাকলে এই প্রথমবারের মতো চীনের বাইরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা চীনের মূল ভূখন্ডের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেল।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close