গাজী শাহনেওয়াজ, মাতারবাড়ী (কক্সবাজার) থেকে ফিরে
শেষ হচ্ছে আঞ্চলিক হাফপোর্টের যুগ
মাতারবাড়ি হবে স্মার্ট বন্দর, মিলবে দুই ধরনের সুবিধা
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর। এটি চালু হলে সমূদ্রপথে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে। দেশকে আর্থিকভাবে সাবলম্বী করতেও এ বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, এটি হবে স্মার্ট বন্দর। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের অনেক দেশ এই বন্দরটি ব্যবহারে আগ্রহী হবেন। কারণ, এখানে আন্তর্জাতিক মানের বড় পণ্যবাহী জাহাজ (মাদার ভেসেল) ভিড়বে। এতোদিন ধরে সে সুযোগটি নিয়ে আসছে শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর, মালয়েশিয়ার তেনজিন পালাপাস বন্দর ও সিঙ্গাপুর বন্দর। আগামীতে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পণ্যের বড় চালান পাঠাতে ভিনদেশী রাষ্ট্রের বন্দরের দিকে আর তাকিয়ে থাকা লাগবে না। শেষ হবে আঞ্চলিক হাফপোর্ট ব্যবহারের যুগ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, দুটি বিষয়ে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। তাদের আর্থিক ক্ষতি অর্ধেকে নেমে আসবে। স্বল্প সময়ে পণ্য পৌঁছে যাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কারণ, বর্তমানে আমেরিকায় পণ্যের একটি চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। এই বন্দরে অপারেশন কার্যক্রম শুরু হলে ২৩ দিনেই পণ্য পৌঁছে যাবে নির্ধারিত গন্তব্যে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণে ব্যয় হবে ৯ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের সিংহভাগই জোগান দিচ্ছে জাপানি প্রতিষ্ঠান জাইকা। বাকি অর্থের সংস্থান করছে চট্টগ্রাম বন্দর ও সরকার। ছয় বছর মেয়াদী প্রকল্পের প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয়ে চালু হবে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে। এর আগে ২০২০ সালে ১ জানুয়ারি প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি প্রস্তরের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে এর উপযোগিতা ও প্রাক-উপযোগিতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, বন্দর নির্মাণে জাপানের নিপ্পন কোই নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শক চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে।
নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, মাতারবাড়ি বন্দরের কার্যক্রম চালু হবে ২০২৬ সালে। এই সময়ে শুরুর জন্য যে ধরণের কার্যক্রম দরকার, সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয়তা ছিল। দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর থেকেই বলছেন সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কথা। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হলে বিশাল এই জলারাশি কাজে লাগাতে হবে।
তিনি বলেন, যারা এই কক্সবাজারের বাসিন্দা তারা ছাড়া বাইরের কেউ মাতারবাড়ি চিনত না। এটাকে দেশের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মাতারবাড়িতে লবন ছাড়া আর কিছুই হতো না। সেখানে স্মার্টনগরী গড়ে উঠছে। স্মার্ট বন্দর তৈরি হচ্ছে। এখানের স্মার্টনেস টা সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই বন্দরে ৮২০০ টিইইউস ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বড় কন্টেইনার জাহাজ ভিড়ানো যাবে।
প্রকল্প সংশি¬ষ্টরা বলছেন, এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। বন্দরের জন্য যে চ্যানেল তৈরি হয়েছে সেটি ২৫০ মিটার চওড়া, ১৮ দশমিক পাঁচ মিটার গভীর এবং ১৪ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ। এটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। বন্দরের জন্য চ্যানেল তৈরিতে বিদ্যুতের প্রকল্পের করা ২৫০ মিটারের সঙ্গে আরও ১০০ মিটার চওড়া চ্যানেল, পৃথক জেটি নির্মাণ ও কনটেইনার রাখার স্থান হলে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ আরও অনেক সহজ হবে। এর আগে জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশনার জন্য ছয়টি বয়া চ্যানেল তৈরি করা হয়। পরে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটি বন্দরে রূপ দিতে গভীর সমুদ্রবন্দর নামে প্রকল্প নেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, দুই ধাপে বন্দরের কাজ হবে। এর প্রথম ধাপে একটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ হবে। চাহিদার আলোকে এটা আরও বাড়তে পারে। বন্দরের সঙ্গে চার লেনের একটি সড়ক নির্মাণ হবে, যেটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হবে। এর মাধ্যমে দেশ পাঁচটি বন্দরের মালিক হবে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর এবং মীরসরাই ইকোনমিক জোন সংলগ্ন প্রথম বেসরকারি সমুদ্রবন্দর।
প্রকল্পের সমন্বয়ক অতিরিক্ত সচিব মো. ইউসুফ আলী বলেন, একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারের জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি চাহিদা পূরণ এবং মাতারবাড়ি ও মহেশখালী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহনে সহায়তা করাই এ বন্দর প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান হাইড্রোগ্রাফার কমডোর মো. আরিফুর রহমান বলেন, দেশের নৌবন্দরগুলোতে মাদার ভেসেল নোঙর করার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তাই আমরা এখান থেকে পণ্যের চালান আঞ্চলিক অফ পোর্টগুলোতে পাঠাই। এগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর রয়েছে। ইউরোপগামী যখন সুবিধাজনক (সুইটেবল) জাহাজ পাওয়া যায়, সেখানে সংরক্ষিত পণ্যগুলো লোড করে গন্তব্যে নিয়ে যায়। আগামীতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে কারো মুখাপেক্ষী হওয়া লাগবে না। পণ্যগুলো সরাসরি ওই বন্দর থেকে বিভিন্ন দেশে চলে; এটাই বড় সাফল্য।
প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্মসচিব মো. জাহিদ হাসান বলেন, গভীর সমুদ্র বন্দরে একটি টার্মিনাল হবে, জেটি থাকবে দুইটি।
পিডিএস/এমএইউ