সঞ্জয় সুত্রধর, শিবালয় (মানিকগঞ্জ)

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

শিবালয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুই অপারেশন

শিবালয় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রেজাউর রহমান খান জানু। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

রেজাউর রহমান জানু ছিলেন মাহফুজ কোম্পানির কমান্ডার। তার ভাই অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খান ছিলেন উপ-আঞ্চলিক কমান্ডার। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে যুদ্ধকালের দুইটি অপারেশন এবং দুটি মর্মস্পর্শি ঘটনার বিবরণ দেন।

‘ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী ও অধ্যাক্ষ আব্দুল রউফ খানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রাম থেকে ঘিওর থানা অপারেশনের জন্য রাতের অন্ধকারে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা রওনা হই। ১ মাইল নৌকাযোগে ঘিওর থানা থেকে আধা মাইল দূরে নৌকা থেকে নেমে রওনা দেই। সকাল ১১ টার দিকে ঘিওর সদরে পৌঁছি। সেদিন ছিল বুধবার, ঘিওর হাটের দিন। সবেমাত্র হাট বসেছিল। আমরা ঘিওর থানা ঘিরে ফেলে মুর্হুমুর্হু গুলি করতে থাকি। পাহারাদার কনষ্টেবল ভয়ে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা থানায় গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ধরে ফেলি। তার কাছ থেকে আস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে ৬ টি ৩০৩ রাইফেল ও ১ টি পিস্তল ও ২ প্যাকেট গুলি উদ্ধার করি। ঠিক তখন শুনতে পাই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। সেটা ছিল পাক বাহিনীর পাল্টা আক্রমনের চেষ্টা। আগের রাতে তারা ঘিওর স্কুলে ক্যাম্প করেছিল। তারা ক্রমান্বয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকে। নিশ্চিত হয়ে আমরা হরিরামপুর থানার আজিমনগর ক্যাম্পে যেতে থাকি। আমরা যে ৪০ টি নৌকা নিয়ে ঘিওর গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

আমরা আবার ঘিওর থেকে নৌকাযোগে আজিম নগরের দিকে রওনা হই। জানতে পারি পাক বাহিনী ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উথলী ব্রিজে অবস্থান নিয়েছে। আমরা আবার উথলী আসার সিদ্ধান্ত নেই। নৌকায় অস্ত্র রেখে জেলে সেজে উথলী ব্রিজে আসি। দেখি পাকসেনারা পালিয়ে গেছে। আবার নৌকা নিয়ে আরুয়া ইউনিয়নের দিকে যেতে থাকি। আমরা খুবই ক্ষুধার্ত ছিলাম। আরুয়া ইউনিয়নের ঘোনাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়াই। দেখি শাহ আলমের মা ভাত রান্না করছেন। তিনি আমাদেরকে উনুন থেকে ভাত নামিয়ে গামলায় করে নৌকায় দিলেন। আমরা গোগ্রাসে খেয়ে ক্ষুধা নিবারন করি। তারপর আরুয়া ইউনিয়নের মালুচি গ্রামের দিকে রওনা হই। মালুচি গ্রামের যজ্ঞেশ্বর সাহার ঘাটে দেখা হয় ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী, দোহার থানার রায়পাড়া ইউনিয়নের সিরাজ চেয়ারম্যান ও পুলিশের হাবিলদার আব্দুল ছালামের সাথে। আব্দুল হালিম চৌধুরী বললেন, এখনি মালুচি ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হবে। ওখানে শিবালয় থানার ওসি রাজাকারদের সহযোগীতায় হিন্দুদের বাড়ি লুট করছে এবং যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা চার জন মালুচী স্পটে গিয়ে তিন দিক থেকে রাজাকারদের আক্রমন করি। প্রচন্ড গোলাগুলি হয়। গোলাগুলির সময় থানার ওসি নিহত হন আর রাজাকাররা পালিয়ে যায়। আমরা ওখান থেকে ৪টি ৩০৩ রাইফেল, ১টি পিস্তল, নগদ ৭ হাজার টাকা উদ্ধার করি।

ঘিওর থানা অপারেশন কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা আওলাদ হোসেন। ওই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সাবেক যুগ্ম সচিব ইয়াকুব আলী, আওয়ামী লীগ নেতা মো. দ্বারা মিয়া, আয়নাল ফকির, অসিত কুমার দত্ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আব্দুল হাকিম, আব্দুল রফিক সুর্য, আব্দুল আহাদ, ইউসুফ আলী, আ. উহাব, পুলিশের নায়েক আব্দুস সালাম।

অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন আ. মাজেদ, শহীদ, আব্দুর রব, শান্ত মিয়া, খন্দকার শাহ্ আলম, আব্দুল বাতেন, আব্দুল খালেক, চুন্নু মিয়া, আ. হাকিম, বাবলু, আ. কাদের, নৌকার মাঝি কিয়াম উদ্দিন, হাশেম উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, মোকছেদ, এলমেছ, সাহেদ আলী, আরশেদ, নুরু, খলিল, চান্দা, আলাল কাজী, হাকিম উদ্দিন, হাকিমুদ্দিন ও জাকেরসহ অনেকে।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রেজাউর রহমান খান জানু আরো জানান, নভেম্বর মাসের শেষের দিকের আরেকটি লামহর্ষক ঘটনা। ঘটনার স্থান ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারীপাড়া গ্রামের কাছে রত্নাদিয়া ঝিলে। ‘আমি তখন শহীদ মাহফুজ কোস্পানীর কমান্ডার। আমি তখন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হই। শরীরে প্রচন্ড জ্বর। যোদ্ধারা আমাকে ছুটি দিয়ে মায়ের কাছে যেতে বলেন। মা মাহমুদা বেগম নবাবগঞ্জ উপজেলার শিকারী পাড়া গ্রামের খ্রীষ্টানপল্লী সোনাবাজু নিবাসী এস্থানী গোমেস টিকে মাষ্টার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি ক্যাস্প থেকে ১টি স্টেনগান দুই ম্যাগাজিন গুলি নিয়ে মায়ের কাছে রওনা হই। সন্ধ্যা বেলায় এসে মায়ের কাছে পৌঁছি। মা আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মা খেতে দেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তখন রাত আনুমানিক ১২টা। এর মধ্যে খবর পাই পাশ্ববর্তী রত্নাদিয়া ঝিলে পাকসেনারা অবস্থান নিয়েছে। এস্থনী গোমেজের সন্দেহ তার বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিয়েছি জেনেই পাকসেনারা তার বাড়ি আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা পাকসেনাদের অবস্থান দেখার জন্য দুই জনই ঝিলের পাশে যাই। আমাদের সাথে ১০-১২ জন যুবক ছিল। দূর থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকি। রাত ভোর হলে পাক হানাদাররা বালিরটেকের দিকে চলে যায়। আমরা ঝিলে দিকে এগিয়ে এসে দেখি একজন পাক সেনা সদস্য ঝিলের উচু স্থানে বসে আছেন। আমরা সন্তর্পনে সাথে তার কাছে পৌঁছে স্টেনগান পিঠে ঠেকিয়ে বলি ‘হ্যান্ডস আপ’। আমাদের সাথে থাকা যুবকেরা তার দুই হাত ফেলে। তার কাছে থাকা একটি চাইনিস পিস্তল, গুলি, গ্রেনেড ও বেনোয়েট উদ্ধার করি। দেখি সে ভিষণ অসুস্থ। গুলি লাগার কারণে তার পা দুটো পচে গিয়েছিল। সাথীরা তাকে ফেলে চলে যায়। আমরা একটি বাঁশে দড়ি বেঁধে তাকে গোমেজের বাড়িতে নিয়ে আসি। আমার মা তাকে পানতা ভাত খেতে দেয়। সে ব্যাগ থেকে নিজের পরিবারের ছবি দেখিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তার নাম শমসের আলী খান। সে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের পদাতিক বাহিনীর সদস্য। কাকতালীয়ভাবে ওই দিন দুপর বেলা ভারত থেকে মুন্সীগঞ্জ হয়ে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী ওই বাড়ীতে আসেন। ক্যাপ্টেনের নাম শুনেই ওই পাক সেনা তাকে সেল্যুট দেয়। তাকে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর কাছে সোপর্দ করি।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিবালয়,মুক্তিযুদ্ধ,অপারেশন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close