আরিফ মঈনুদ্দীন

  ১৯ জানুয়ারি, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস : পর্ব ২

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

ইব্রাহিম হোটেলে একটি ছোট কাজ করে। এখানের পারিপার্শ্বিক কারণে কাজে ছোট-বড়টা যদিও লজ্জার না, কিন্তু স্বদেশের স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন-তিনটা সনদপত্র নিয়ে তার আরো ভালো একটি কাজ পাওয়া উচিত ছিল। প্রশ্ন করলে লজ্জায় চুপসে যেতে যেতে বলে ওঠে- ওটা বাংলাদেশের পড়াশোনা। বাংলাদেশের সার্টিফিকেট শুধু বিয়ে করতে গেলে কাজে লাগবে। আশ্চর্য! ইব্রাহিম শুদ্ধ করে একটি ইংরেজি সেনটেন্স পর্যন্ত দেশ থেকে শিখে আসেনি। ডিগ্রি ক্লাসের সিলেবাস থেকে নাকি ইংরেজিকে প্রায় নির্বাসন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রথম লন্ডনে এসে ইয়েস-নো-ভেরিগুড দিয়ে চালিয়ে এসেছে। এখন লিখতে তেমন না পারলেও বলার কৌশল কিছুটা আয়ত্ত করে ফেলেছে। ইংরেজি না-জানার কারণে। শফিক আহমেদের সুপারিশটাও কাজে লাগেনি। চাকরিটা প্রায় হয়েই গিয়েছিল শফিক আহমেদ সাহেবের কলেজের অফিস সহকারী। ইব্রাহিমের জন্য অপ্রত্যাশিত সুযোগ। বেতনও অনেক বেশি ছিল তুলনামূলক বিচারে।

মিসেস আহমেদ ইব্রাহিমকে নিয়ে আলাপে মেতে উঠলেন। তিনি দেশের প্রতি ভীষণ দুর্বল। দেশের খোঁজখবর ইত্যাদি জানার আগ্রহ এবং বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে কথা বলতে তার দারুণ ভালো লাগে। ইব্রাহিম টেলিফোনে এলাকার যাবতীয় খুঁটিনাটি জেনে নেয় তার বন্ধু সাঈদের কাছ থেকে। আর এখানে এলেই ওসব হুবহু কাকিমার সুস্বাদু খাবারে পরিণত হয়ে যায়।

গত পরশু সাঈদের ফোন পেয়েছে। ফোনে কথা বলে ইব্রাহিমের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী বাড়ির মকিম মণ্ডলের ছেলে দুবাই থেকে এসেছে। দেখতে বেশ আলু আলু হয়েছে। কোনদিনকার পুঁচকে ছ্যামড়া এখন নাকি চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বাহারি স্যুট পরে বিনা কাজে ঘুরে বেড়ায়। রাস্তার মোড়ের চা দোকানগুলোয় তার অনেক ভক্ত। পাইকারি চা’র অর্ডার দেয়। সুন্দর সুন্দর সিগারেটের প্যাকেটের সিলেকন ছিঁড়ে বাবার বয়সি তামাকখোরদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নিন খান একটা, বড়ই মজাদার। ইংরেজ সাহেবরা খায়। আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি, হাজার হলেও এই গেরামের ছেলে। আপনাদের জন্য তেমন আর কী-ই বা করতে পারছি।

ধূম বেশ মজার জিনিস। একটা সিগারেটের লেজ দেখিয়ে নাকি অনেক ধূমখোরকে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা পিছে পিছে হাঁটানো যায়। আমাদের সংস্কৃতিতে বড়দের সামনে সিগারেট-বিড়ি খাওয়াটা শিষ্টাচারের পরিপন্থি। কিন্তু মকিম মণ্ডলের ছেলের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে আগুন ধরাচ্ছেন রহিম শেখ, কেনু মাতবর, করিম খান। এরা সবাই সমাজে আচার-বিচার করে। গাঁয়ের পোলাপানরা তাদের দেখলে রাস্তার কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়।

মণ্ডলের পোলা বাহাইরা (বাহার উদ্দিন) সিগারেট খাক- চা দোকানে হরিলুটের বাতাসা বিলাক। সানগ্লাস পরে ফাজলামি করুক। এতে ইব্রাহিমের কোনো অভিযোগ নেই। কারণ স্বাধীনতা বলে তো একটা কথা আছে। যেমন আমাদের দেশের মেয়েরাও তো পুরুষের পোশাক পরে স্বাধীনতা চর্চা করছে। ছেলেরা ইচ্ছামতো চুলের বেণি দোলাচ্ছে, পার্কের বেঞ্চিতে মুখোমুখি বসে যুবক বলছে, নাটোরের বনলতা সেন এতদিন কোথায় ছিলেন। ওটা বাহাইরার নিজের ব্যাপার। ইব্রাহিমের চটে যাওয়ার কারণ অন্যটি। সুন্দর পরীর মতো দেখতে তার ছোটবোন ঝরনা ফেরদৌস ঝুনু, সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। দেখে মনে হবে মুজিব মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। বিয়ের জন্য টানাটানি অবস্থা। গ্রামের মানুষরা পেয়েছেটা কী। এজন্যে সে বাবাকে বলেছিল শহরে বোনের বাড়ি আছে। একটা ভালো স্কুল দেখে ভর্তি করিয়ে দিলেই হয়। মা আবার মেয়ের ব্যাপারে সাংঘাতিক। অত সুন্দর মেয়েটাকে চোখে চোখেই রাখতে হবে। বড় খালার একমাত্র আদরের দুলাল রহমান গতবার বিএ পাস করেছে। গ্রামে হেঁটে হেঁটে টিউশনি করে। তেনার আবার শখ জেগেছে ঝুনুকে পুত্রবধূ বানানোর। যত্তসব বাজে চিন্তা। সবেমাত্র পাস দিয়েছে এবার না-হয় একটা ভালো চাকরিবাকরির খোঁজে নামাবে। তা না- বিয়ে। কেমন আহলাদের আহ্লাদ।

আর চাকরি! এত কষ্টে বিএ পাস করে। সে নিজেইও তো কোনো ব্যবস্থা করাতে না পেরে সুন্দর মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসে চলে এসেছে। শুধু টাকা কামানোর জন্য।

বাহাইরার বাবা নাকি রহিম শেখকে দিয়ে ঝুনুর বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বাবা এখনো তাকে কিছু বলেনি। সাঈদ খবরটা জানিয়ে দিয়েছে আগে আগে। বাবার আবার আশঙ্কা আছে, ঝুনুকে যে-হারে সে ভালোবাসে, হয়তো বাহাইরাকে শায়েস্তা করার জন্য বিলেত থেকে রাতারাতি গ্রামে এসে হাজির হবে। রহিম শেখ ভালোভাবেই জানে মকিম মণ্ডল ইব্রাহিমদের খেতে কত কামলা দিয়েছে। গ্রামে দিনমজুরি করে পেট চালিয়েছে। কিন্তু চা দোকানের পাইকারি খাতির আর সুন্দর প্যাকেটের সিগারেটের এই গুণ। শেষপর্যন্ত রহিম শেখের মতো একজন মাতুব্বরও এতবড় একটা ভুল করল! ইব্রাহিম দেশে থাকলে ব্যাটাকে আচ্ছা করে একটা অপমান করা যেত।

ইব্রাহিমের কথা হলো, মকিম মণ্ডল কামলা দিয়েছে তো কী হয়েছে! তার ছেলে উপযুক্ত হলে বিংশ শতাব্দীর এ যুগে সে অতসব খুঁজতে যাবে কেন। বাহাইরা মণ্ডলের কামলাগিরির পয়সায় দুই-দুইবার মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল মেরে তৃতীয়বার বিদ্যা চুরির (নকল) অপরাধে এক্সফেল্ট হলো। শেষে মণ্ডলের শেষ সম্বল সামান্য জমিজিরেত বিক্রি করে দুবাই পাড়ি দিল। সে নাকি বিয়ে করতে চায় তার পরীর মতো ফুটফুটে বোনটাকে। রাগে তার গায়ের মাংস কামড়ে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। শুধু সে বাড়িতে ছিল না বলে বান্দির বাচ্চাটা বেঁচে গেল। সাঈদ বলেছে, তুই চিন্তা করিস না। আমরা দেখব, রহিম শেখ তোর বাবার সঙ্গে যেদিন কথা বলেছে, তার পরদিন থেকে বাহাইরাকে আর রাস্তায় দেখছি না। চাচায় খুব করে শাসিয়ে দিয়েছে রহিম মাতুব্বরকে। আর আমিও বলে দিয়েছি- ঝুনুর ভাই বিদেশে। কিন্তু ওই ফাজিলটাকে শায়েস্তা করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট।

ইব্রাহিমের বকবকানি শিউলির খারাপ লাগে না। কিন্তু এখন লাগছে। বিষয় একটিই মন খারাপ। মা বেশ গুরুত্ব দিয়েই শুনছেন। যদিও শিউলি জানে মাইকেলের জন্য আজ আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। কিন্তু কেন সে এলো না, চিন্তা করতে করতে সে ঘেমে উঠল। তাহলে কি প্রোগ্রামটা বাতিল করা হয়েছে? শিউলি আয়নায় নিজেকে দেখল। হঠাৎ মনে হলো- তার চেহারাটা ভীষণরকম মলিন হয়ে উঠেছে। নিজেকে চিনতে পারছে না। বিকেলের শিউলি আর সন্ধ্যার শিউলি দুজন মনে হলো আলাদা। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। এত অল্পতে ভেঙে পড়লে কি চলে? শিউলি ভাবল- এত সুন্দর করে মেচকরা ড্রেসটা যখন পরাই হয়েছে, তা কিছুটা হলেও কাজে লাগানো দরকার। থার্ড ফ্লোর থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।

থার্ড ফ্লোর শিউলির বান্ধবী লীরাদের বাসা। লীরার বাবা কয়েকটি হোটেলের মালিক। বাঙালিরা এখানে এসে হোটেল ব্যবসাটাকে বেশ পছন্দ করে। এতে তেমন বুদ্ধিসুুদ্ধির দরকার হয় না। মোটা বুদ্ধিওয়ালা যেকোনো লোকও বেশ কামাই করতে পারবেন। অবশ্য লীরার বাবা হক সাহেব রসায়নে এমএসসি করেছেন। স্বদেশেই। আর লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে তখন এখানে আসা। এখানে সেটা আর হয়ে ওঠেনি; সুতরাং বিদ্যা অথবা টাকা দুটোর একটা তো হতেই হবে। তারপর থেকে টাকার পেছনে ছুটছেন মি. আজিমুল হক তফাদার। বাংলাদেশের তুলনায় খারাপ করেননি। কিন্তু পাউন্ড স্টারলিং-এর দেশে মধ্যবিত্ত হয়েই তিনি সুখী। দুই ছেলে এক মেয়ের সংসার। ছেলে হাসান এবং জিসান ওখানের দূতাবাস স্কুলে পড়াশোনা করে, মেয়ে লীরাই বড় সে এবার ইন্টারমিডিয়েট দেবে। ছেলেমেয়েকে দূতাবাস স্কুলে পড়াচ্ছেন। এদেশে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা তার কোনোকালেই ছিল না। এক দিন স্বদেশে ফিরে যাবেন। কিছু পয়সাকড়ি হলে দেশে গিয়ে ভালো একটা ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে। দেশে যখন যাবেনই সুতরাং ছেলেমেয়েদের স্বদেশের কালচার থেকে আলাদা করা ঠিক হবে না। বিশেষ করে এখানকার পারিবারিক জীবনের প্রতি হক সাহেবের শুরুতেই যে ঘেন্না ছিল। তা এখনো রয়ে গেছে এবং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। দূতাবাস স্কুলে প্রবাসী বাঙালিদের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে নিজ দেশের সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে। ছেলেমেয়েরা ইউরোপিয়ানদের পারিপার্শ্বিক দ্বারা আক্রান্ত হলে তা সারানো দস্তুর মতো মুশকিল হয়ে পড়বে। চোখের ওপর দেখেছেন স্বদেশের কত ছেলেমেয়ে উচ্ছন্নে গেছে। তাদের বাবা-মাদের ভেতর যারা কিছু মনে করেন না বা করছেন না অর্থাৎ যারা ‘ডোন্টমাইন্ড ফ্যামিলি’ভুক্ত তারা তো সমানে সমান। আর যাদের ভেতর পাপবোধ আছে তাদের অনেকে ছেলেমেয়েদের বাগে আনতে চেষ্টা-তদবির করে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু হক সাহেব ছিলেন শুরু থেকে সচেতন। আর তিনি এই সচেতনতার পেছনে এমনভাবে লেগেছিলেন, এতে তার ব্যবসাপাতির কিছুটা ক্ষতিও হয়েছে- যেমন মেয়ের গতিবিধির ওপর খেয়াল রাখার জন্য অনেক সময় রেস্টুরেন্টে যাননি। ম্যানেজারকে বলেছেন জরুরি কাজ আছে তুমি দেখো। মেয়ের সঙ্গে কোন কোন মেয়ের বন্ধুত্ব আছে। তারা কেমন? চারিত্রিকভাবে এবং পারিবারিকভাবে। তাদের বাবা-মাদের যাপিত জীবনের অধ্যায়গুলো পবিত্র কি-না। ইত্যকার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখেছেন খুব কাছ থেকে। মেয়ের ছেলে বন্ধুর ব্যাপারটা তিনি ডিসকারেজ করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। শেষপর্যন্ত দেখা গেল মেয়েকে তিনি মনের মতো করেই গড়েছেন। পশ্চিমা হাওয়ায় অন্য মেয়েদের মতো তার বুকের ওড়না এবং মাথার স্কার্ফ উড়িয়ে নিতে পারেনি। এটা ভেবে তিনি দারুণ আনন্দিত। মিসেস হকও এ ব্যাপারে দারুণ সচেতন ছিলেন। মেয়ে যখন সেভেন-এইটে পড়ত তখন মাঝে মাঝে তার সতীর্থ এবং আশপাশের ফ্ল্যাটের দু-একটি মেয়েও আসত। মিসেস হক তাদের খোঁজখবর নিতেন। যাদের কথাবার্তা এবং চালচলন সুবিধের মনে হতো না, তাদের প্রতি আপ্যায়নের মাত্রাটা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতেন। কখনো কখনো আপ্যায়নের মাত্রা মাইনাস পজিশনেও নামিয়ে দিয়েছেন।

একবারের ঘটনা, মিসেস আজিমুল হক মানে রাশেদা আক্তার এবং লীরা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক আর মাকে এমন একজন বন্ধু হিসেবে পাওয়াতে লীরার ভালো থাকাটা বহুলাংশে ত্বরান্বিত হয়েছে। মা-মেয়ে কী-একটা ব্যাপারে লুটোপুটি খেয়ে হাসছে। হঠাৎ কলিংবেল বাজল। ভরদুপুরে হঠাৎ বেরসিকের মতো বেলটা বেজে উঠল। তারা গল্পে গল্পে এমন মাতোয়ারা হলো যে, উঠে দরজা খুলতে ইচ্ছে করছে না। লীরা উঠে দরজা খুলতে এগোচ্ছিল। ওকে থামিয়ে দিয়ে মিসেস রাশেদা আক্তার এগিয়ে গেলেন। হাতে যত কাজই থাকুক বেল বাজলে রাশেদা আক্তার দরজা খোলেন এবং যদি দেখেন মেয়ের কোনো অপ্রত্যাশিত বন্ধুবান্ধব এসেছে, গেট থেকেই আপ্যায়নের ধরন সম্পর্কে তিনি ধারণা করে নেন। দরজা খুলে রাশেদা আক্তার দেখলেন- স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে প্যান্টের ওপর একটি ঢিলে শার্ট পরিহিত একটি মেয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close