আরিফ মঈনুদ্দীন

  ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ১৩)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

আমার কথায় পুরো মনোযোগ ঢেলে না দিলে আমি কারো সঙ্গে কথা বলে মজা পাই না। তা তো তুমি জানোই। তবে এটাতে আরো বেশি মনোযোগ চাই। অন্তত এ মুহূর্তে তোমার ব্যবসাপাতির চিন্তা ভুলে থাকো।

হক সাহেব কফিতে শেষ চুমুক দিলেন। মগটা টি-টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, কফিটা চমৎকার বানিয়েছ। এটা তোমার বানানোর গুণ নাকি কফির উৎকৃষ্টতা- কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে আমি মুহূর্ত বিলম্ব না করে বলে দেব এটা তোমার হাতেরই যশ। অর্থাৎ তোমার বানানোর গুণ। যেটা খেয়ে মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের অনাহূত সব গিঁট খুলে যাচ্ছে। খুব যেন চাঙা হয়ে উঠলাম। তোমাতে মনোযোগ দেওয়ার এটাই উত্তম সময়।

রাশেদা আক্তার খাটের ওপর পা তুলে বসেছেন। সদ্য পড়া শেষ করে ওই বইটি হাতে ধরে আছেন। হক সাহেব খাটের ওপর স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন।

রাশেদা আক্তার বললেন, বইটি পড়ে আমার ভেতর একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। প্রত্যেকেরই নিজ দেশের জন্য অনেক কিছু করার আছে। আর যে বিষয়টি শিখলাম এবং তোমাকে জানাব ভাবছি তা হলো, ‘চরিত্রহীন বুদ্ধিমান লোক ধূর্ত শিয়াল আর বুদ্ধিহীন চরিত্রবান লোক উন্নতমানের গুরু’। অর্থাৎ চরিত্রহীন লোক যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে তার সব মেধা ও বুদ্ধি বিভিন্ন প্রকার সমাজবিধ্বংসী ক্রিয়াকর্ম এবং সমাজের তথা রাষ্ট্রের অকল্যাণে নিজের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করবে।

হক সাহেব বললেন, হ্যাঁ তাই তো- আচ্ছা রাসু, তোমার ‘শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা’ গল্পটা মনে আছে? যেখানে বোকা কুমিরের ছানাগুলো ধূর্ত শিয়ালের মজাদার খাবার হয়েছিল। তোমার কথা শুনে আমার ওটা মনে পড়েছে।

রাশেদা আক্তার বললেন, হ্যাঁ মনে আছে। তবে আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। তুমি আমাকে আর একটু সময় দাও। বুদ্ধিসুদ্ধি নেই এ রকম বেআক্কেল ধরনের লোক যদি চরিত্রবান হয় তাতে তার নিজের হয়তো ঝামেলামুক্ত থাকা হলো। কিন্তু ওই লোকগুলো সমাজের কোনো কাজে আসে না। অর্থাৎ এ ধরনের লোকজনের ওপর কোনো ব্যাপারেই নির্ভর করা চলে না। ব্যাপারটা আরো খোলাসা করে এভাবে বলা যেতে পারে। চরিত্রহীন বুদ্ধিমান লোক সমাজের জন্য কীটসদৃশ এরা ঝাড়া বদমাশ। এখানে চরিত্র বলতে দৈহিক-নৈতিকসহ একজন ব্যক্তির সামগ্রিক চরিত্রকে বোঝানো হচ্ছে।

স্বামীকে উদ্দেশ্য করে রাশেদা আক্তার বললেন, তোমার কি এ বিষয়টা থেকে এ রকম মনে হয় না?

কী রকম?

বলতে গেলে পুরো পৃথিবীটাই এখন চরিত্রহীন বুদ্ধিমান লোকের হাতে শাসিত হচ্ছে।

হক সাহেব অস্থির বেদনা অনুভব করে বললেন, রাখো তো তোমার পুরো বিশ্বটা। আমার প্রিয় বাংলাদেশ সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?

শুধু তোমার প্রিয় হতে যাবে কেন। আমি কি বাংলাদেশকে কম ভালোবাসি। আর এরই মধ্যে তুমি নিশ্চয়ই টের পেয়েছো যে, ভালোবাসা না থাকলে আমি কেন দেশে ফিরে যেতে এত পীড়াপীড়ি করছি।

ভালোবাসো সে তো বুঝলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি।

রাশেদা আক্তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ, বাংলাদেশও আজ চরিত্রহীন বুদ্ধিমান লোকের খপ্পরে। তা না হলে স্বাধীনতার এত বছর পরও আমার এ দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হবে কেন? এখানের কর্তাব্যক্তিদের মুখে বলে একরকম। অন্তরে অন্তরে লালন করে অন্যরকম। এদের দৈহিক কিংবা নৈতিক চরিত্রের- এ দুদিকের কোনো দিকেই উৎকর্ষ অর্জিত হয়নি। আধুনিক বিশ্বের কোনো কোনো দেশের নেতানেত্রী আমলাদের ভেতর নৈতিক দিকটার ভালো প্রতিফলন দেখা যায়। আমাদের দেশে এদিকটার এতই অধঃপতন হয়েছে যে এখানে ঘুষ-দুর্নীতিই যেন নিয়ম হয়ে বসেছে।

হক সাহেব বললেন, আচ্ছা রাসু, নাগরিক হিসেবে আমাদের এখন কী করা উচিত?

আমাদের অনেক অনেক কিছুই করার আছে, বলতে পারো সবকিছু দেশের লোকরাই তো করবে। দেশ পরিচালনার জন্য কাউকে তো ভাড়া করে আনা যায় না। আমাদের প্রয়োজন এখন সচ্চরিত্রবান বুদ্ধিমান নাগরিকের অর্থাৎ এমন নাগরিক যিনি চরিত্রবান তিনিই বুদ্ধিমান। দেশ পরিচালনায় যারা নেতৃত্ব দেবেন তাদের এ দুটো গুণের সঙ্গে আরেকটি দিক বিবেচনায় আনা হবে- তা হলো নেতৃত্বের গুণাবলি।

হক সাহেব বিদুষী সহধর্মিণীর কথায় বারবার পুলকিত হচ্ছেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে বেগম, তোমার কথাই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হবে। দেশে আমরা ফিরে যাবই, তবে মাত্র আর কটা দিন।

‘তোমার আর কটা দিন’ শেষ হবে কবে? এটা তো সেই কবে থেকেই বলা হচ্ছে- বলতে বলতে রাশেদা আক্তার একটা রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ধরে রাখলেন।

হক সাহেব বললেন, আগে তো এদিকটার সব গোছগাছ করে নেব, এখানের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে ঢাকায় গিয়ে তো কিছু শুরু করতে হবে এবং সেটাই এখন আমার একমাত্র চিন্তা।

রাশেদা আক্তার বললেন, কিছু আবার কী? তুমি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় তো বেশ ভালো করেছো, দেশেও আজকাল এই ব্যবসা রমরমা। অনেক হোমরা-চোমরারাও এই ব্যবসায় নেমে পড়েছে, তুমিও তাই করবে।

আজিমুল হক সাহেব আত্মতৃপ্তির সুরে বললেন, আমিও এ রকমই ভাবছি। তুমি তো আমার মনের খবর জেনে ফেলেছো।

এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

অবশ্যই স্বাভাবিক। এতগুলো বছর একসঙ্গে আছো। এটুকু না বুঝলে কি হয়, হা-হা-হা।

হঠাৎ কলিংবেল বাজল। আজিম সাহেব বললেন, তুমি বোসো আমি দেখছি।

আইহোলে চোখ করে আজিমুল হক সাহেব আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লীরার বান্ধবী-টান্ধবী হবে হয়তো। তিনি ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন কে?

মেয়েটি আজিমুল হক সাহেবের কণ্ঠ চিনেছে। সে বলল, আংকেল আমি প্রফেসর শফিক সাহেরব মেয়ে শিউলি। আমরা সাততলায় থাকি।

শফিক আহমেদ সাহেবের সঙ্গে আজিমুল হক সাহেবের জানাশোনাটা ভালোই আছে। তিনি বললেন, ও আচ্ছা।

বলতে বলতে আজিম সাহেব গেটটা খুললেন। গেট খুলেই তিনি একটু থতমত খেলেন। মেয়েটার ড্রেসআপটা তার পছন্দ হচ্ছে না। তিনি মেয়েটাকে ভেতরে আসার আহ্বান জানাতে-না-জানাতেই মেয়েটি উনাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। অনেকটা, গেট যখন খোলা হয়েছে তার তো আর ভেতরে যেতে বাধা নেই। এ রকম ব্যাপার। কিন্তু স্বাভাবিক সৌজন্য এবং মেয়েসুলভ একটু ব্রীড়ার অনুশীলন তিনি আশা করেছিলেন। কিন্তু এর ছিটেফোঁটাও এই মেয়ের চলনবলনে পরিলক্ষিত হয়নি। তিনি একটু আহত হলেন এবং ওর পরনের পোশাক দেখে তিনি প্রমাদ গুনলেন। স্কিনটাইট জিনসের প্যান্টের সঙ্গে ইন করা টি-শার্ট। শরীরটা মনে হচ্ছে ফেটে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এই ধরনের পোশাক তিনি নিজের মেয়ের জন্য কখনোই নির্বাচন করেন না। যদিও লন্ডনের পরিবেশে এই ড্রেসটা একেবারেই স্বাভাবিক। মেয়েটির চোখণ্ডমুখের অভিব্যক্তিত্বে বাঙালিসুলভ লজ্জার কোনো উপস্থিতিও নেই। তিনি ক্ষণিকের অন্যমনস্কতা থেকে উঠে এসে লীরাকে ডেকে বললেন, কই রে মা লীরা...

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close