অলোক আচার্য

  ০৩ মে, ২০২৪

প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ

প্রেম মানবসভ্যতার এক অনিবার্য পরিণতি। এই নিখিল ধরণীতে প্রেমহীন কোনো প্রাণীই থাকে, না থাকতে পারে না। সৃষ্টির আদিতেও প্রেম ছিল। প্রেম না থাকলে এই বিশ্ব সৃষ্টিই হতো না। প্রেম শাশ্বত, প্রেম চির সুন্দর। প্রেম অবিনাশী। সৃষ্টিশীলতার জন্য প্রেমের অবদান অনস্বীকার্য। দেশ-কাল-পাত্রভেদে প্রেমের সংজ্ঞাও এক। সেই প্রেম দৈহিক না মানসিক অথবা মনোদৈহিক কোনটা, সেই হিসাব পরে। প্রেম অস্বীকার করার কারো নেই, ছিল না। ঠিক এ কারণেই দেশে-বিদেশের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে উঠে এসেছে প্রেমের জয়গান। উঠে এসেছে রোমিও-জুলিয়েট বা দেবদাস-পার্বতীরা অথবা জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন বা সুরঞ্জনা। পেছনের তত্ত্ব আর কিছুই না, প্রেম। একে-অন্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, মোহ বা পাওয়ার আকুতি। আবার দূরে থাকলেও চাওয়া গভীর হয়। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। প্রেম যেমন গদ্যে রয়েছে, কবিতাও এর বাইরে থাকেনি। রাখাও সম্ভব না। ঘুরে-ফিরেই এই এক রস শব্দ হয়ে ছন্দে মিলেছে। বাঙালির আদি পরিচয় চর্যাপদের কবিদেরও রচনার একটি ক্ষেত্র ছিল প্রেম। চণ্ডিদাস ও বড় চণ্ডিদাসের রচনায় প্রেমের বহু রচনা পাওয়া যায়। যদিও প্রেম শব্দটিকে বহুমাত্রিকতায় বিভক্ত করা চলে। এরপর বৈষ্ণব পদাবলিতে বাঙালি রসের সন্ধান পায়। সেই রসের নাম প্রেম। তবে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের অঙ্কুরিত আকাঙ্ক্ষা বা কামনা প্রেম হয়ে সমাজের রন্ধ্যে মিশে গেছে। বাঙালি তরুণ সমাজে আলোড়িত করার মতো প্রেমকাহিনি নিয়ে আসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। লেখকের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের নবকুমারের কথা সামনে আসে। আর সেই যে কপালকুণ্ডলার বিখ্যাত উক্তি, পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো? সেখান থেকে উপন্যাসে প্রেমের শক্ত যোগ ঘটে। তারপর কপালকুণ্ডলা-নবকুমারের শেষ পরিণতি ঘটলে আসে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম ইউরোপ হয়ে ভারতবর্ষে আগমন করে। সেই প্রেম আদিকাল ধরে চলা গৎবাঁধা প্রেমের চেয়ে ভিন্নতর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে যেন প্রেমের নবজাগরণ ঘটে। তার গান, কবিতায় প্রেমের নব নব রূপ সঞ্চিত হতে থাকে।

আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকে সাধকও বলেছেন। একজন একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধক। জমিদার পরিবারে বড় হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বকবি হয়ে ওঠার সময়কালে নিজে এই বাঙালি সমাজের কাছে এক বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার লেখার মোহমায়ায় তৎকালীন বাঙালি সমাজকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। এখনো কিন্তু সেই আলোড়ন সমাপ্ত হয়নি। বরং রবীন্দ্র গবেষকরা প্রতি নিয়তই তার বিষয়ে নতুন নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করছেন। আজও বাঙালি সমাজ বিশ্বকবির রেখে যাওয়া প্রেমের বাণীতেই মেতে আছেন। আজও গুণগুণ করে গানের কলিতে কবিগুরুর প্রেমের স্তুতি সাধনা করে। এই যে বাঙালিকে দেড় শতাধিক বছর ধরে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন, সে কি আর এত সহজেই পেরেছেন? এখন প্রশ্ন হলো, কবিগুরুর সাধনা করা প্রেম শারীরিক না মানসিক ছিল? এর উত্তর হতে পারে দুটোই ছিল, তবে শরীরের চেয়ে মনের পরিতৃপ্ত অন্তরঙ্গ সাধনাই ছিল প্রধান। অর্থাৎ প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি মনকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। আবার প্রকৃতি প্রেম ও ঈশ্বর প্রেম, সেও মিলেছে তার কথায়, গানে ও সুরের মুর্ছনায়। তিনি মিশেছেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সঙ্গে, প্রার্থনা করেছেন নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার। নিখাদ প্রেম ছাড়া এ অসম্ভব। তিনি ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত রোমান্টিক চেতনার পুরুষ। যদিও সমালোচকদের কাঁচিতে তাকে নানাভাবে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। তার অভিব্যক্তিকে শারীরিক প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। পরিবারে কবিগুরুর বৌদির সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, তারও ব্যবচ্ছেদ প্রায়ই করেন সমালোচকরা। যদিও প্রেমের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে শরীর ও মন দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ। আবার প্রেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই উপাদান হলো নারী ও পুরুষ, যা ছাড়া সমাজ অসম্পূর্ণ। মানবসভ্যতা যার ওপর ভিত্তি করে বিস্তার লাভ করেছে, সে তো এই নারী-পুরুষের চিরায়ত প্রেম। তা সে যেভাবেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন না কেন, নারী-পুরুষের প্রেম ছাড়া প্রেম অসম্পূর্ণ এবং অপূরণীয়।

সৃষ্টির আদিতত্ত্বে প্রেমের সেই সংজ্ঞাই লুকিয়ে রয়েছে। কবিগুরুর ভাষায়, ‘স্ত্রী-পুরুষগত প্রেমের ন্যায় প্রবল শক্তি আর কিছু আছে কি না সন্দেহ। এই শক্তি ষোলো আনা মাত্রায় সমাজের কাজে লাগাইলে মানবসভ্যতা অনেকটা বল পায়। এই শক্তি হইতে বঞ্চিত করিলে সমাজের একটি প্রধান বল অপহরণ করা হয়।’ তবে শরীরের প্রকাশে দোষ নেই। তাহলে সহজ প্রশ্ন উঠতে পারে। সেটি হলো, প্রেমের ধর্ম আসলে কী? কবিগুরু সেই ধর্মকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন? সেক্ষেত্রে তার বক্তব্য হলো, ‘প্রেমের ধর্ম এই, সে ছোটোকেও বড়ো করিয়া লয়। আর, আড়ম্বর-প্রিয়তা বড়োকেও ছোটো করিয়া দেখে। এই নিমিত্ত প্রেমের হাতে কাজের আর অন্ত নাই, কিন্তু আড়ম্বরের হাতে কাজ থাকে না। প্রেম শিশুকেও অগ্রাহ্য করে না, বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে না, আয়তন মাপিয়া সমাদরের মাত্রা স্থির করে না।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা মধ্যযুগে যে রকম চর্চা করা হতো, বর্তমানেও সেভাবে চর্চা করা হচ্ছে। কারণ কবিগুরুর প্রেমের কবিতার আবেদন কালের গণ্ডি পেরিয়েছে এবং সম্ভবত এত গভীর প্রেমবোধের কবিতা আজ পর্যন্তও লেখা হয়নি। তবে প্রেমের কবিতা হচ্ছে প্রচুর। কবিগুরু ভালোবাসার স্বরূপ খুঁজেছেন বহুরূপে, বহুভাবে। ভালোবাসা কি কেবল মানবহৃদয়ে দহন অনুভূতি জাগায়? সে কি কেবল যাতনাময়? নাকি যাতনার ভেতরেও এক ধরনের স্নেহতর আনন্দানুভূতি বিদ্যমান থাকে এবং বোধ করি, সেই অনুভূতিটুকুর প্রত্যাশায়ই মানবহৃদয় লুণ্ঠিত হয়। কবির জিজ্ঞাসায়, ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলি যাতনাময়?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য বহুবর্ণময়। তার কাব্য কখনো রক্ষণশীল ধ্রুপদি শৈলীতে, কখনো হাস্যোজ্জ্বল লঘুতায়, কখনো-বা দার্শনিক গম্ভীরে, আবার কখনো বা আনন্দের উচ্ছ্বাসে মুখরিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার স্বীকৃতি বিশ্ব জুড়েই। তাই তো তিনি বিশ্বকবি। আর এসবের মধ্যে আলাদাভাবে বললে বলা যায়, তার প্রেমের কবিতাগুলো এর মধ্যে উল্লেখযোগ। কারণ প্রেমের যতসব রূপ আছে, তার প্রতিটি শাখায়ই তিনি কবিতা লিখেছেন। প্রেমের পাওয়া, না-পাওয়া, অবিশ্রুতি প্রেম, দাম্পত্য জীবনের মোহ, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি আরো বহুভাবে কবিতায় প্রেমের আকুতি জানিয়েছেন।

প্রেম মানুষকে আনন্দ দেয়, মোহিত করে। আবার প্রেম বেদনাও দেয়, অন্তরকে দগ্ধও করে। কবিগুরু কিন্তু প্রেমের আনন্দকে ক্ষণস্থায়ী বলেছেন এবং বিপরীতে প্রেমের বেদনাকে দীর্ঘস্থায়ী বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন।’ অর্থাৎ প্রেমের কষ্টও এক ধরনের সুক্ষèানুভূতির আনন্দ, যা মানুষ আজীবন ধরে রাখে। এমনকি ধরে রাখতে না চাইলেও থেকে যায় সেই বেদনা। প্রেম এমনই এক সত্য, যা চাইলেই অস্বীকার করা সম্ভব না। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে উনত্রিশ বছরের ছোট ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে কবির প্রেম সত্যিই যেন একটি মিথ। কে এই বিদেশিনী? বলা হয়, এই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিপরীতে এই বিদেশিনী সুন্দরী রমণীটির প্রতিক্রিয়া ঠিক কি ছিল, তা জানা যায় না। তবে কবিগুরুর ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’ গানটি যে এই মেম সাহেবকে নিয়েই লেখা, তা একটি প্রচলিত বিশ্বাস। আরো কিছু নারীর কবিগুরুর জীবনে আসার ব্যাপারে জানা যায়। এর মধ্যে কবির একজন গুণমুগ্ধ লেখিকা ও মারাঠি কন্যার কথা জানা যায়। যদিও এখানে প্রেম শব্দটিকে নারীর সঙ্গে ব্যাখ্যায় বেশিই গৌণ করা হয়ে যায়। কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো প্রকৃতি সাধক বা প্রেমিক, আবার ঈশ্বর প্রেমিকও বটে। আবার মানবপ্রেমেরও রয়েছে বহুভাগ। আশ্চর্য বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসব প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপন সত্ত্বাকে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। খাঁটি প্রেম কিন্তু সেরকমই। নিজেকে বিলিয়ে দিলেই কেবল সে প্রেমের সন্ধান মেলে। তবে কবিপত্নীর সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড় ও খুঁনসুটির। জানা যায়, বৌদির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ঠাকুরবাড়িতে গুঞ্জন ওঠার পরপরই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। যা হোক, সে অন্য কথা। এতকিছু আলোচনায় এটাই কেবল স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মননে, চিন্তা ও ভাবাদর্শে একজন প্রকৃত প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। তার প্রেম চেতনা বিকশিত লাভ করেছিল মানুষে, প্রকৃতিতে ও ঈশ্বরে। হয়তো সে কারণেই তাকে সাধকও বলেন অনেকে। তিনি সেদিক থেকে প্রেমেরও সাধক। কবিগুরুর বৈশাখের এই আগমনের দিনে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close