আরিফ মঈনুদ্দীন

  ০৩ মে, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ১৪)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না, ততক্ষণে লীরা তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। শিউলিকে দেখিয়ে বলল, আব্বু ওকে চিনছো না? শফিক আংকেলের মেয়ে শিউলি।

আজিম সাহেব ইতস্তত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বললেন, ও হ্যাঁ। ও তো তা-ই বলল।

লীরা অত্যল্প উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল, তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে তাহলে!

হ্যাঁ। তোমরা কথা বলো। আমি আসি বলেই আজিম সাহেব ভেতরের রুমে গেলেন। তার মনটা ভার হয়ে গেল। লীরাকে বিষয়টা বুঝতে দেননি।

স্বামীর চেহারার হঠাৎ পরিবর্তন দেখে রাশেদা আক্তার বললেন, কী ব্যাপার? দরজা খুলতে গেলে। এলে মন খারাপ করে। কে এসেছে?

আরে ওই প্রফেসর শফিক সাহেবের মেয়ে। নাম বলল লীরা।

কী ব্যাপার, তুমি ওই মেয়েকে চেনো না? আমাদের সাততলায় থাকে।

আজিম সাহেব যথারীতি মন খারাপ করেই বললেন, চিনেছি হয়তো। দু-একবার দেখেছি। কিন্তু... কিন্তু বলে তিনি একটু থামলেন।

রাশেদা বললেন, কিন্তু কী?

কিন্তু যে কী! তুমি বরং ড্রইংরুমে গিয়ে একবার দেখে এসো।

কী কোনো সমস্যা? বলতে বলতে রাশেদা ড্রইংরুমের দিকে গেলেন।

রাশেদা আক্তারকে দেখে শিউলি মেয়েটি অবশ্য সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কী কেমন আছো? বলতে বলতে তিনিও একটু ধাক্কার মতো খেলেন। শিউলির পরনের পোশাক একেবারেই ভালো লাগল না। তিনি বেশি কথা না বলে স্বাভাবিক সৌজন্যবশত বললেন, ঠিক আছে বোসো। তোমরা কথা বলো...। বলেই তিনি শোয়ারঘরে এসে স্বামীকে লক্ষ করে বললেন, মেয়েটির ড্রেসআপটা আমারও পছন্দ হয়নি। বিষয়টা তো এই?

হ্যাঁ ঠিক ধরেছো। তবে মেয়েটি তো ঘরে ঢোকার সময় আমাকে সালামও দিল না এবং স্বাভাবিক মেয়েসুলভ লজ্জাটজ্জাও দেখলাম না।

আমাকে অবিশ্যি সালাম দিয়েছে। হতে পারে হয়তো ঢোকার সময় খেই হারিয়ে ফেলেছে। সালামের বিষয়টা বাদ দিলেও মেয়েটির লজ্জাশরম যে নেই তা তো পরনের ড্রেস দেখেই বলা যায়। শরম থাকলে এই ড্রেস পরা যায় না কি।

আজিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, এই মেয়ে তো লীরার বান্ধবী হওয়া ঠিক না।

আসলে বান্ধবী ওরকম না। ওই যে বলে না গলায় গলায় ভাব। ওটা না। একই ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে তো- হয়তো দেখাসাক্ষাৎ হয়। এতেই কিছুটা খাতির। আমার মেয়েকে তো আমি জানি। এর সঙ্গে ওরকম খাতির লীরার হবে না। প্রফেসর সাহেবের মেয়েটির চলাফেরা ভালো না। বোধহয় একটু শুনেছিও। লীরাকে বিষয়টা বলতে হবে। এই মেয়েকে এড়িয়ে চলতে হবে। তুমি মন খারাপ কোরো না। বিষয়টা আমি দেখছি।

হ্যাঁ, আমি মন খারাপ করব না। তোমার ওপর আমার ভরসা আছে। মেয়েটি বিদায় হোক। তারপর লীরার সঙ্গে কথা বলব।

বাবার চেহারায় খানিকটা পরিবর্তন লীরার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিষয়টা ভাবতে থাকাতে শিউলির সঙ্গে আলাপটা জমে উঠছে না। শিউলির ড্রেসটাই ওর জন্য দায়ী- এটা লীরার কাছে পরিষ্কার। তার অন্যমনস্কতা শিউলির চোখে ধরা পড়েছে। সে কনুই দিয়ে আলতো করে গুঁতো দিয়ে বলল, কী রে, তুই তো প্রাণ খুলে কথা বলছিস না। কোনো সমস্যা?

লীরা রাখঢাক না-করেই সরাসরি বলল, সমস্যা তো তুই নিজে। যে ড্রেস পরে বাবার সামনে পড়েছিস। এটা বাবার একদম পছন্দ না। আমি এটাই ভাবছি। তোর দিকে মনোযোগ দিতে বিষয়টা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিউলি খানিকটা অভিমানী সুরে বলল, তাহলে কি চলে যাব। এলাম মনটা ভালো করার জন্য। এখন দেখছি গুড়েবালি।

শিউলি চলে যাক এটা লীরা চায়। কারণ ওর সঙ্গে ভালো পরিচয় থাকলেও বন্ধুত্বটা অত জোরালো নয়। কারণ ওই একটিই- শিউলির চলাফেরাটা লীরারও পছন্দ না এবং ইদানীং তার আচার-আচরণ থেকে পুরো জীবনপদ্ধতি কেন যেন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যে পরিবর্তনটা লীরার বাবা-মা শুধু না, সে নিজেও নিতে পারছে না; সুতরাং ওর মতো মেয়ে তাদের বাসায় আসুক এটা সে চায় না। তার পরও স্বাভাবিক সৌজন্য রক্ষা করার জন্য বলল, আচ্ছা তোর গুড়ের বালিটা আপাতত সরিয়ে রাখছি। বল এ রকম সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?

আপাতত সরিয়ে রাখছিস মানে কী? আবার সময়মতো ছিটিয়ে দিবি নাকি। আচ্ছা থাক রসিকতা বাদ। শুধু মন ভালো করার জন্য নয়। তোর কাছ থেকে একটা সাজেশনও দরকার আছে...

শিউলিকে থামিয়ে দিয়ে লীরা বলল, তার আগে বল। তুই এভাবে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস? কোনো পার্টিপুর্টি আছে নাকি?

তুই ঠিকই ধরেছিস। পার্টি ছিল। কিন্তু কী কারণে যেতে পারিনি এখনো জানি না। যে আমাকে নিতে আসার কথা ছিল সে এলো না। মনে হচ্ছে কোনো কারণে বাতিল হয়েছে। ভাবলাম, এত সুন্দর করে সেজেছি। অন্তত কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আর ওই যে বললাম একটা সাজেশন। সেটাও আলাপ করব। তার আগে বল ড্রেসটাতে আমাকে কি ভালো লাগছে না?

ভালো তো একেকজনের কাছে একেক রকম। তোর ড্রেসটা আমাদের মতো বাঙালিদের কাছে মোটেই পছন্দ না। তোর শরীরটা কেমন লোভনীয় হয়ে ফুটে রয়েছে বুঝতেছিস না।

শিউলি পরম তৃপ্তিতে হাসতে হাসতে বলল, দোস্ত তোকে ধন্যবাদ। আমি তো চেয়েছিও তাই।

তোর যে এই প্রত্যাশা এটা বুঝতে আমার বাকি নেই আর...

গভীর উচ্ছ্বাসে লীরাকে থামিয়ে দিয়ে শিউলি বলল, আর যাই বলিস তুই পুরুষ হলে বোধহয় আমাকে এখনই ঝাপটে ধরতি।

সেটা ভিন্ন কথা। যারা ধরার তারা ধরত। তোর ধরার লোক নিশ্চয়ই আছে। তা কোথায় যাওয়ার কথা ছিল?

কথা ছিল আমার বন্ধু মাইকেল আসবে। ওদের কোম্পানির একটি প্রোডাক্ট লঞ্চিংয়ের প্রোগ্রাম ছিল। সেখানে আবার শহরের সেরা সেরা মডেলরাও আসবে। আমারও আজকে একটা মহড়া ছিল। মাইকেল বলছিল সুযোগ হলে মডেলিংয়ে একটা সুযোগ দেবে। আরেকবার বলেছিল। খুশিতে গদগদ হয়ে বোকার মতো বাবা-মাকে বলে দিয়েছিলাম। তারা তখন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিল। এখন তাদের না-জানিয়ে গোপনেই নামটা লিখিয়ে ফেলব ভাবছি। পরে যখন যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, তখন আপনা থেকেই তারা মেনে নেবে।

লীরা একটা কটাক্ষের সুর ও চাহনিকে গোপন করে একটু কৃত্রিম আহলাদ প্রকাশ করে বলল, তোর তলে তলে এত জল?

তা নয়তো কী? এভাবে না-হলে তো এগোতে পারব না। আচ্ছা আরেকটি বিষয়। তোরা লন্ডনের মতো আধুনিক শহরে বসবাস করে এমন সেকেলে হয়ে রইলি...

শিউলিকে থামিয়ে দিয়ে লীরা বলল, আমরা সেকেলে না। আমরা মার্জিত রুচিবোধ লালন করি, এমনভাবে চলাফেরা উচিত না। তোর শরীর সম্পদ অনাহূূত অবাঞ্ছিত কাউকে উসকে দেয় এটা চরমভাবে দৃষ্টিকটু। যারা ভোগবাদে বিশ্বাসী তারা তো তোর খুব প্রশংসা করবে এবং তোর সঙ্গে কিছু- একটা করতে পারার প্রতিযোগিতায় নামবে। কিছু-একটা কী? বুঝতে পেরেছিস তো।

শিউলি কিন্তু ও রকমই চায়। তাকে দেখে ছেলেরা মরমে মরে যাক। এরা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাক। এটা তার কাছে একটা খেলা। এই খোলায় সে দারুণ মজা পায়। সে নিজের বদখত ইচ্ছাকে ঢেকে রেখে বলল, তোর সঙ্গে এ নিয়ে আমি তর্ক করব না। শুধু এটুকু বলি, তোর ধারণাটাও আমি উপভোগ করছি। আচ্ছা এখন তোর কাছ থেকে সাজেশনটা চাই।

লীরা বুঝে ফেলেছে এই মেয়ে তো জেগেই আছে। এর ঘুম ভাঙানোর বৃথা চেষ্টা না করে একে বিদায় করাই বিধেয়। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে একে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে। ওদিকে বাবা-মা নিশ্চয়ই ওর বিদায় হওয়ার পথ চেয়ে আছে। সাতপাঁচ ভেবে সে বলল, তোর কী সাজেশন? বল শুনি।

বিষয়টা হলো আমার নামটা আমার পছন্দ না। কেমন মরামরা নাম- ম্যাড়মেড়ে ধরনের। নামে কোনো ঝংকার নেই। কোনো ছন্দ নেই। কেমন লাগে শুনতে!

লীরা অবাক হয়ে ভাবে, বলে কী এই মেয়ে। কী সুন্দর একটি নাম! শিউলি ফুলের নামে নাম। তার পছন্দ না। বোঝা গেল শিউলি মেয়েটা গোল্লায় যেতে বসেছে। বসেছে কী ইতিমধ্যে চলেও গেছে। ভাবতে ভাবতে সে বলল, কী বললি? ম্যাড়মেড়ে নাম! তা তুই কী ধরনের নাম ধারণ করতে চাস? মোগল সম্রাটদের সহযোগিতা নিতে পারিস। তারা তো ক্ষমতায় গেলে নিজের নাম তো পরিবর্তন করতই, বেগমদের নামও পরিবর্তন করে ফেলত। যেমন সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের আগের নাম ছিল আরজুমান্দ বানু বেগম। সম্রাজ্ঞী মেহেরুন নিসার নাম ছিল নূরজাহান।

শিউলি এক রকম অভিমান করে বলল, দোস্ত হেঁয়ালি রাখ তো। একটা নাম ঠিক করে দে।

লীরা চাচ্ছে শুধু অভিমান নয় শিউলি রাগ করলেই বরং ভালো। তাহলে বাসায় আসাটাও বন্ধ হতো। সে যথারীতি হেঁয়ালি করেই বলল, ধুর এটা কোনো সমস্যা হলো নাকি। কত নামই তো আছে, তোর প্যান্ট-শার্টের সঙ্গে মিলিয়ে একটা খুঁজে নে। এই যেমন ধর ব্রিজিত বার্দোত, কারদেসিয়ান, সোফিয়া লরেন আরো কত কী।

শিউলি বলল, সোফিয়া লরেন বাদ। এতে বাংলাদেশের সুফিয়া সুফিয়া গন্ধ আছে। আমি ভাবছি ইভানকা রাখব... তুই কী বলিস?

ভালোই তো, বিখ্যাত মডেল। তবে যতটুকু মডেল হিসেবে বিখ্যাত তারচেয়ে বেশি বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্যা হিসেবে। হ্যাঁ পারিস। এই নাম ধারণ করতে পারিস। তবে নামটা কিছুটা কমন হয়ে গেলেও তুই মডেল হিসেবে ওকে ছাড়িয়ে গেলে আর অসুবিধা থাকবে না।

টিটকারি মারছিস?

ধুর পাগল। টিটকারি মনে করলে টিটকারি। তুই এসব গায়ে মাখলে তো আসল টার্গেটে পৌঁছাতে পারবি না।

আচ্ছা ঠিক আছে, আজ থেকে আমি ইভানকা। দেখি নামটা মাইকেলের পছন্দ হয় কি না?

হু দ্যাখ।

শিউলি কয়েক মুহূর্ত কিছু-একটা চিন্তা করে বলল, তাহলে আজ উঠি?

লীরা এতক্ষণ এই মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিল। সে ঝটপট বলল, ঠিক আছে ওঠ।

শিউলি একরকম হনহন করে বেরিয়ে গেল। লীরা ইচ্ছা করেই আপ্যায়ন প্রসঙ্গে গেল না। বাবার চেহারায় সে যা দেখেছে- কখন আপদটা বিদায় হবে, এটাই ছিল তার চিন্তা। এতে যদি শিউলি রাগ করে আর না আসে তাতেই রক্ষে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close