নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

  ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং

একসময়ের সন্ত্রাসকবলিত নারায়ণগঞ্জে এখন বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা। একসময় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কাছে তটস্থ থাকত নারায়ণগঞ্জের মানুষ। এখন সেটা কমে গেছে। তবে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে কিশোর অপরাধ। কখন, কে এদের হাতে মারধর কিংবা হত্যার শিকার হয় তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। ভয়ংকর খুনের মিশনে নেমেছে কিশোর গ্যাং।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন নামে পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে কিশোর সন্ত্রাসী বাহিনী। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে কিশোররা। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক কারবার ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে কয়েকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবতা প্রকাশ পায়।

গত ২৪ জুলাই পাওনা টাকা নিয়ে বিরোধের জের ধরে মাসুদ (২৭) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে একদল কিশোর। ফতুল্লার পাগলা নয়ামাটি এলাকার কিশোর গ্যাং গ্রুপের প্রধান সোহেল বাহিনী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোহেলকে মিষ্টিমুখ করানোর একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। যেখানে স্থানীয় প্রভাবশালী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মীরু তাকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। এলাকায় মাদক কারবারসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত এই সোহেল বাহিনী।

গত ১৮ আগস্ট আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে ফতুল্লার দেওভোগ মাদরাসাসংলগ্ন হাজিবাড়ি মাঠ এলাকায় হামলা চালায় স্থানীয় চিহ্নিত কিশোর গ্যাং ডেভিড বাহিনী। হামলায় ওমর ফারুক ও ইমন গ্রুপের ইমন নিহত হয়। এ ঘটনায় থানায় করা হয় মামলা। মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজন আসামি গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতা ডেভিড পলাতক রয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানান, কিশোর গ্যাং লিডার ডেভিডের আসল নাম রিয়াজুল হক। পৈতৃক সূত্রে ডেভিড নাম না থাকলেও কয়েক বছর ধরে এলাকায় নিজের আধিপত্য প্রকাশের জন্য নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন ‘ডেভিড’ উপাধি। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত ডেভিডের নাম ধারণ করে সে।

২০০৪ সালের নভেম্বরে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে ওই ডেভিড নিহত হয়। তার নামে হত্যাসহ ৩৩টি মামলা ছিল। সেই ডেভিডের নামানুসারে নিজের এবং কিশোর গ্যাংয়ের নামকরণ করে দেওভোগ ও আশপাশ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল নব্য ডেভিড বাহিনী।

সিদ্ধিরগঞ্জেও দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে সম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বাহিনীর নাম ‘টেনশন গ্রুপ’। এই গ্রুপের সদস্যরা মাদক কারবার ও মাদক সেবনসহ নানা অপকর্মে জড়িত বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। বিভিন্ন সময় ছিনতাই, মারামারির মতো ঘটনার সৃষ্টি করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করাই এদের কাজ। গত ১২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় নাসিক ২ নম্বর ওয়ার্ডের আমজাদ মার্কেট এলাকায় এক মাল্টিপারপাস কর্মীকে মারধর এবং গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে গ্রুপটির সদস্যরা।

২০২০ সালের ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানি ঘাট এলাকায় দুটি কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষের সময় পানিতে ডুবে নিহত হয় কদম রসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মিনহাজুল ইসলাম মিহাদ ও বিএম ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র জিসান আহম্মেদ। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে বন্দরে আরো পাঁচটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে কিশোর গ্যাং দ্বারা।

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে অভিভাবকরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি প্রশাসনকেও বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ প্রশাসন বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা রোধ করতে অভিভাবক, সুধীসমাজ, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরসহ সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল বলেন, এদের শাসন করতে গিয়ে আমরাও অনেক সময় বিব্রতবোধ করি। পঞ্চায়েতের মাতবররাও বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। বয়স দেখলে বোঝার উপায় নেই এদের সংঘটিত অপরাধ কত ভয়ংকর।

সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে বাদল বলেন, অনেক সময় পরিবারের লোকজনের আশকারাও পাচ্ছে তারা। নিজের এলাকা রসুলবাগ মাদানিনগর ক্যানেলপাড় সামনের সড়কে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ও বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রশাসনকে এখনই এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে হবে। আমরাও প্রশাসনের পাশে থাকব।’

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘মোড়ে মোড়ে জটলা পাকিয়ে শক্তি প্রদর্শন করা, ক্ষিপ্র গতিতে মোটরসাইকেল দাবড়িয়ে বেড়ানো, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এদের দমন করতে না পারলে ভবিষ্যতে এই গ্যাং বড় সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে। এদের রুখতে হলে বা সংশোধন করতে হলে প্রশাসনকে ও তাদের অভিভাবকদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে চরম মূল্য দিতে হবে।’

ফতুল্লা থানার ওসি রাকিবুজ্জামান জানান, পাগলার মাসুদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মূলহোতা সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেওভোগে খুনের ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপরাধ দমনে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close