প্রিন্স রাসেল

  ২২ অক্টোবর, ২০১৮

বদলে যাওয়া ইমরুল কায়েস

সপ্তাহ তিনেক আগে ছেলে সন্তানের জনক হয়েছেন ইমরুল কায়েস। পিতৃত্বের সংবাদটা অজানা নয় বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। খবরটা নতুন আঙ্গিকে জানিয়ে দিলেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় শতক হাঁকিয়ে। উদ্যাপনটাও আবার বিখ্যাত হয়ে আছে বহু বছর আগে থেকেই। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে গোল করে অভিনব এক উদ্যাপন করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি বেবেতো। কাল মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই দৃশ্যের পুনর্মঞ্চায়ন করলেন ইমরুল।

তিন অঙ্ক ছোঁয়া মাত্রই মাটিতে হেলমেট রেখে দুই হাতে ব্যাট দোলাতে লাগলেন ইমরুল। অনেকটা বেবেতোর মতোই বিখ্যাত উদ্যাপন। তাকে অভিবাদন জানিয়ে গোটা স্টেডিয়ামের জ্বলে উঠল মোবাইলের আলো। সেই আলোয় আলোকিত ইমরুল।

অথচ এই ইমরুল তো এশিয়া কাপের দলে ছিলেন না শুরুর দিকে। তামিম ইকবালের ইনজুরি ও টপ অর্ডারের ব্যর্থতা খুলে দিয়েছিল তার জাতীয় দলের দরজা। ঢাকা থেকে সোজা দুবাই গিয়ে কোনো অনুশীলন ছাড়াই ব্যাট হাতে বাংলাদেশের ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হয়েছিলেন বাঁ-হাতি ওপেনার। কাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটিতেও বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা ইমরুল।

এ বছরটা ভালোই কেটেছে বাংলাদেশের। কিন্তু হোম অব ক্রিকেটে খুব একটা খেলার সুযোগ হয়নি। সেই যে বছরের শুরু দিকে ত্রিদেশীয় সিরিজ। এরপরই শুরু একের পর এক বিদেশ সফর। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আরব আমিরাতে নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করেছে টাইগাররা। দীর্ঘ ৯ মাস পর অবশেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে নিজেদের মঞ্চে।

এই প্রত্যাবর্তনটা হলো মনে রাখার মতোই। হেমন্তের পড়ন্ত বেলায় শেরে বাংলার গ্যালারিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মাঠের বাইরেও উপচেপড়া ভিড়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কোনো ম্যাচে মিরপুর এমন জনস্রোত এর আগে দেখেনি। কিন্তু দর্শকদের আরাম করে খেলা দেখার সুযোগ হচ্ছিল না। সমর্থকদের হতাশ করে সাজঘরে ফিরে গেছেন বেশির ভাগ ব্যাটসম্যান।

ভরসা হয়ে থাকলেন শুধুই ইমরুল। ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিল আবারও কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছিল তাকে। এমন ম্যাচে প্রায় এক দশকের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটাই খেললেন তিনি। বোঝালেন অভিজ্ঞতার মূল্য। তার ১৪৪ রানের ঝলমলে ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়ে জিম্বাবুয়েকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বাংলাদেশ। ইনিংস শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় আট উইকেটে ২৭১।

১০ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে কখনোই জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি ইমরুল। দলের অভিজ্ঞ যে কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন তাদের সবাই প্রত্যেকে নিজের জায়গায় সেরা হয়ে উঠেছেন। ব্যতিক্রম শুধুই ইমরুল। কারণটা ইনজুরি এবং অফ ফর্ম। ইমরুলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স অবশ্য তেমনটা বলছে না। ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে কাল পর্যন্ত ১৮টি ওয়ানডে খেলেছেন এই বাঁ-হাতি। যেখানে তার ব্যাটিং গড় ৪৭.২৫। বাংলাদেশ দলে তার ওপরে ব্যাটিং গড় আছে শুধু একজনেরই। তিনি তামিম ইকবাল (৬১.৬৪)। হাতের ইনজুরির কারণে এই সিরিজে অবশ্য দর্শক সারিতে তিনি।

চোটের কারণে এই সিরিজে নেই মিডল অর্ডারের স্তম্ভ সাকিব আল হাসানও। এ দুজনের অনুপস্থিতি বাংলাদেশকে ভোগাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। তেমনই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ইমরুল হয়ে উঠলেন আস্থার প্রতীক। প্রায় একাই টাইগারদের ইনিংস টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। ইনিংস খেলার পথে তিনি উল্লেখযোগ্য সঙ্গ পেয়েছেন মুশফিকুর রহিম, মোহাম্মদ মিঠুনের। তবে ইমরুলকে যোগ্য সমর্থনটা অবশ্য দিয়েছেন সাইফুদ্দিন। ১৩৯ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর এই বোলিং অলরাউন্ডারকে নিয়ে সপ্তম উইকেটে দেশের পক্ষে রেকর্ড সর্বোচ্চ ১২৭ রানের জুটি গড়েছেন ইমরুল। বিধ্বংসী জুটিটা ছিল ১১৫ বলের।

বাবা হওয়ার পর প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেটাতেই ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। পিতৃত্বের স্বাদ যেন বদলে দিয়েছে ইমরুলকে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে ক্রমেই জিম্বাবুয়ের বোলারদের শাসন করেছেন টাইগার ওপেনার। ১৩টি চার ও ৫ ছক্কার ইনিংসটার মাহাত্ম অবশ্য সহজভাবে বোঝানো কঠিন। ব্যাটকে তরবারি বানিয়ে একাই ম্যাচের ভাগ্য বাংলাদেশের অনুকূলে নিয়ে আনেন ইমরুল। এশিয়া কাপে আবুধাবিতে ৭২ রানের ইনিংসে ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই ইনিংসে আবার ছিল জড়তা। কালকের ইনিংসে অবশ্য একটা খুঁত আছে। পঞ্চম ওভারের শেষ বলে ত্রিপানোকে ফ্লিক করতে গিয়ে স্কয়ার লেগে বাউন্ডারির সীমানার কাছে অল্পের জন্য বেঁচে যান। তখন ইমরুলের নামের পাশে যোগ হয়েছে মাত্র সাত রান। জীবন পেয়ে ইনিংসটাকে রাঙিয়ে দিয়েছেন ইমরুল। ব্যাটিং-ই করেছেন অবলীলায়। ফর্ম আর আত্মবিশ্বাস দুটোই যেন ভর করেছিল তার ব্যাটে।

সময় যত গড়িয়েছে ইমরুলের ব্যাট ততই চওড়া হয়েছে। ১১৮ বলে পেয়েছেন দেশের মাটিতে দ্বিতীয় শতক। পরের ৪৪ রান ইমরুল করেছেন মাত্র ২২ বলে। এই ৪৪ রানের ৩৪ এসেছে বাউন্ডারি থেকে। কাইল জার্ভিসকে কাভার দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানা দড়ির সামনে পিটার মুরের দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত হয়ে আউট হয়েছেন ইমরুল। আউট হওয়ার পর টাইগার ওপেনার যখন সাজঘরে ফিরছিলেন তখন পুরো গ্যালারি দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়েছে। পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন সতীর্থ সাইফুদ্দিন এবং জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়রাও। দেশের মাটিতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান করার পুরস্কারটা এর চেয়ে ভালোভাবে পেতে পারতেন না ইমরুল।

তবে কাল বাংলাদেশ জেতায় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন ইমরুল। ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন বলে নয়। ইমরুল ওয়ানডে ক্যারিয়ারে যে দুটি সেঞ্চুরি (২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০১ এবং ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ১১২) করেছেন দুটোতেই যে হেরেছে বাংলাদেশ! কাল অবশ্য ইনিংসটা মাটি করতে দেননি মাশরাফি-মুস্তাফিজরা। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে তুলে নিয়েছেন দারুণ জয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close