রুনা তাসমিনা

  ২৪ জুন, ২০১৭

সিনড্রেলা ও তার ঈদ

আম্মু ছাড় না! আমাকে সিনড্রেলার মতো লাগছে কি না দেখি! আয়নায় নিজেকে দেখার জন্য অস্থির নুহি।

এই তো শেষ, মুকুটটি আরেকটু ভালো করে আটকে দিই! কথা বলতে বলতেই ক্লিপটি আটকানো হয়ে যায় সোনালি চুলের ওপর রুপালি রঙের মুকুটের সাথে। সাজ ঠিক মতো হয়েছে কি না পেছনের দিকে একটু সরে গিয়ে দেখে নুহি। ঠিক যেন ছোট একটি নীলপরী দাঁড়িয়ে আছে সামনে! কপাল ঢেকে আছে সোনালি চুলে। গোলগাল ফর্সা ছোট্ট মুখ, ফিলিপাইনিদের মতো ছোট ছোট চোখ দুটো দেখে অনেকেই বিদেশি বলে ভুল করে প্রথম দেখাতেই। গোলাপি ছোট্ট ঠোঁট দুটিতে হালকা গোলাপি লিপস্টিকের একটু ছোঁয়া লাগিয়ে মায়াভরা মুখটিতে চুমু খেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রুমকি। এই তো সেই গল্পের সিনড্রেলা! দেখি তো! আম্মুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদৌড়ে আয়নার সামনে। পেছনে দাঁড়ানো আম্মুর দিকে মিষ্টি করে হাসে, তুমি ঠিক ঠিক পেরেছ! আমার জাদুর কাঠি কই? স্কুলে আজ স্পোর্টস ডে আছে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতা। নুহি সে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। প্রতিদিন রাতে আম্মুর কাছে সিনড্রেলার গল্প শোনা তার চাই-ই চাই। খুব সাধ সিনড্রেলার মতো নীল জামা পরা প্রিন্সেস হতে! কর্কশিটে তৈরি জাদুর কাঠি হাতে দিয়ে সোনালি চুলগুলো ঠিক করার সময় কপালটা একটু গরম মনে হয়। নীল জামা পরা, সোনালি চুলের মেয়েটিকে দেখ! যেন ছোট এক নীলপরী! পেছন ফিরে রুমকি দেখে ওরা নুহির কথাই বলছে। মাইকে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারী সবার নাম ঘোষিত হওয়ার পর আসে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অধিকারীদের নাম ঘোষণার পালা। রুমকির বুক দুরুদুরু করছে! ঠিক সেই সময় মাইকে নুহির নাম ঘোষিত হয় প্রথম স্থানে! প্রধান অতিথির কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে স্টেজ থেকে নামার আগেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনা বিচারক ম-লীর আসন থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরে নুহিকে। রুমকি একরকম দৌড়েই পৌঁছে যায় স্টেজের কাছে। আনন্দে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়, দেখেছ আম্মু সিনড্রেলা পুরস্কার পায়! খুশিতে উজ্জ্বল মুখটি আরো আদুরে লাগে হ্যাঁ, মা! সিনড্রেলা সবসময় পুরস্কার পায়! গা টা যেন আরো বেশি গরম মনে হয়! বাসায় ফিরেই বিছানায় শুয়ে পড়ে নুহি। বিকেল থেকে বাড়তে থাকে জ্বর! সন্ধ্যায় যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় তখন জ্বরে সারা শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে! রাতে বাবার কোলে বসে ডাক্তারের লিখে দেওয়া সেই তেতো সিরাপটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেতে হয়। টেবিলে রাতের খাবার দিচ্ছিল রুমকি, এমন সময় শাওনের উদ্বিগ্ন ডাক শুনতে পায়-রুমকি, জলদি এসো, নুহি বমি করছে! জ্বরের জন্য কিছুই খেতে পারেনি। হলুদ রঙের কতগুলো পানি মেঝেতে ছিটিয়ে আছে, ক্লান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে নুহি। দিন দিন অসুস্থতা বাড়তেই থাকে। সেদিন চুল আঁচড়ানোর পর চিরুনি দেখেই চমকে ওঠে রুমকি! এত্তোগুলো চুল! যেন পুরু মাথার সব চুলই চিরুনির দাঁতের কামড়ে উঠে এসেছে! তাড়াতাড়ি মাথার চুলে বিলি কেটে দেখে অনেক জায়গায় চুল উঠে গিয়ে সাদা মসৃণ চামড়া দেখা যাচ্ছে! প্রচ- ভয় যেন হৃৎপি- খামছে ধরে! ‘বাবাকে ফোন করে বলি আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে।’ বলেই মেয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রুমকি চলে যায় পাশের ল্যান্ডফোন রাখা রুমে। মেয়ের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত শাওনও। শরণাপন্ন হয় শহরের নামকরা ডাক্তারের। ডাক্তার আঙ্কেল, ‘আমাকে মিষ্টি ওষুধ দেবেন! ওই তেতো ওষুধ খেয়েই আমার বমি হয়েছিল!’ -‘মিষ্টি মেয়েকে মিষ্টি অষুধ তো দিতেই হবে!’ থুতনিতে আদর করে দিয়ে ডাক্তার রুমকিকে ইশারা করেন বাইরে যেতে নুহিকে নিয়ে। চেম্বারের বাইরে বসা রুমকির মনে হয় শাওন অনেককাল ধরে চেম্বারের ভেতরে বসে আছে! নুহি অল্প দূরে রাখা একুরিয়ামে রাখা বিভিন্ন রকমের রঙিন মাছগুলোর খেলা দেখছে। শাওন বেরিয়ে এসে বসে পড়ে রুমকির পাশে। তার বিষণœ মুখের দিকে তাকিয়ে বাড়তে থাকে রুমকির উৎকণ্ঠা! ডাক্তার খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছেন নুহিকে নিয়ে! কিন্তু নুহিকে সেটি বুঝতে দেওয়া যাবে না, কাল থেকে স্কুলে যাওয়া, ছাদে খেলতে যাওয়া, টিচারের কাছে পড়া সব নিয়মিত করতে বললেন। শুধু খেয়াল রাখতে হবে শরীর আর মনের ওপর বেশি চাপ যেন না পড়ে। ওর কী হয়েছে শাওন? ডাক্তার কি বলেছেন আমাকে বলো প্লিজ! রুমকির চোখের জল মুছে দিতে গিয়ে, নিজের চোখ বেয়েই নেমে আসে জলের ধারা। পরদিন মায়ের সঙ্গে স্কুলে যায় নুহি। খুব খুশি স্কুলের বন্ধুদের কাছে আবার আসতে পেরে। প্রধান শিক্ষক আমিনাকে সব খুলে বলে রুমকি। ছুটি হওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে আম্মুর সাথে কথা হচ্ছিল নুহির-‘আম্মু, এবারের ঈদে কিন্তু আমি কাশিশের মতো লেহেঙ্গা কিনবো!’ -‘আর কী কী কিনবে?’ -‘বারবি ব্যাগ, পিংক কালার সু আর হ্যাঁ আমি কিন্তু ঈদের দিন চুল খোলা রাখবো...’ শেষ কথাটিতে বুক যেন টনটন করে ওঠে। মাস দুয়েক পরেই শুরু হবে রোজা। স্কুলে আসার সময় খুব যতœ করে বেঁধেও কিছু কিছু অংশে লুকানো যায়নি চুল উঠে প্রায় টাক হয়ে যাওয়া কিছু অংশ। ভাগ্যিস মাথার অংশ পুরোটা কেউ দেখতে পায় না-নুহিও জানে না তার সোনালি চুল খোলা রাখার মতো অবস্থা নেই। বাসার খুব কাছাকাছি স্কুল হেঁটেই আসছিল দুজন। দ্যাখো, দ্যাখো মেয়েটির মাথাটা কেমন! পাশ দিয়ে যাওয়া রিক্সার এক যাত্রী তার পাশের সঙ্গীকে নুহির কথাই বলছে। মা, মেয়ে দুজনেই একসাথে পেছন ফিরল! অনেক চেষ্টা করেও চুলের নিচে ঢাকতে পারেনি উঠে প্রায় টাক হয়ে যাওয়া মাথার খুলির সাদা কিছু অংশ। নুহি বুঝতে পারলো কথাগুলো তাকে উদ্দেশ করেই। দুধের মতো সাদা ফর্সা মুখে কে যেন মেঘের কালি লেপে দিল! শাওন নেই, ঢাকা গেছে অফিসের কাজে। রাতে ভাতের প্লেট নিয়ে নুহির পাশে বসতেই বললো,

-‘আম্মু! ঈদে কিচ্ছু কিনতে হবে না আমার জন্যে!’ -‘কেন মা? কেন কিচ্ছু কিনতে হবে না?’ ‘ওই আন্টির মতো সবাই আমাকে দেখে চুল নেই বলে হাসবে!’ রুমকির কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে নুহি। বন্ধ চোখের এক অংশে পাপড়ি নেই! আলতো করে মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, পাশের রুমে গিয়ে ফোন করে শাওনকে। কিছু করো শাওন প্লিজ! আমার মেয়েটার দিকে আমি তাকাতে পারছি না--কান্নায় ভেঙে পড়ে রুমকি। বিচলিত হয়ে পড়ে শাওন। কালকের ট্রেনেই ঢাকা চলে এসো। দেখি এখানকার ডাক্তাররা কী বলেন! ঢাকায় ডাক্তারের কথায় অনেকটা আশ্বস্তবোধ করে দুজনেই। সেই হাসি-খুশি, উচ্ছ্বাস নুহির চোখ-মুখ থেকে হারিয়ে গেছে, কেমন একটি শূন্যতা এসে জায়গা করে নিয়েছে সেখানে। পার হয়েছে আরো এক মাস। চুলে লোশন জাতীয় ওষুধটি লাগানোর সময় রুমকির মনে হয় মসৃণ মাথা কেমন খসখসে! ঘরের আলো উজ্জ্বল করে দিয়ে ভালো করে দেখে কালো কালো চুলের ভ্রুণ! শাওন এসে দেখে যাও! মেয়েকে নিজের দিকে ফিরিয়ে চুমু খেয়ে বলে, ‘নুহি সোনা! আর মন খারাপ নয়! আমার নুহির মাথায় নতুন চুল!’ অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে নুহি মায়ের দিকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন দেখে আম্মু সবাইকে ফোন করে জানাচ্ছে, তখন আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ‘বাবা, ঈদে কিন্তু আমি কাশিশের মতো লেহেঙ্গা, বারবি ব্যাগ, পিংক কালার সু কিনবো!’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist