অলোক আচার্য

  ৩০ মার্চ, ২০২৪

লাল চুলের ছেলেটি

কাদের এ বছরই আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সেদিন স্কুলে ঢুকেই দেখি একটি নতুন ছেলে মাঝখানের বেঞ্চিতে বসে আছে। ছেলেটা নতুন। পরনে স্কুল ড্রেস নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক দেখছে। ফরহাদ স্যারের ক্লাসে ছেলেটির পরিচয় দেওয়া হলো। নাম কাদের। কাদেরকে আমরা বখাটের দলেই ফেলেছিলাম। ওর চালচলন ঠিক আমাদের মানে ক্লাসের আর সবার মতো ছিল না। বয়সেও আমাদের চেয়ে অনেকটা বড় ছিল। টিফিন পিরিয়ডে কত দিন দেখেছিল হাজু চাচার দোকানের পেছনে লুকিয়ে বিড়ি টানতে। আমরা কেউ ওই দোকানের কাছেই যেতাম না। স্যারেরাও চোখে চোখে রাখতেন। কিন্তু আশ্চর্য হলো কাদেরকে কিছু বলতে দেখিনি।

কাদেরের বিষয়ে জানাজানি হলে ওর সম্পর্কে আমাদের কাছে পরিবার থেকে রেড অ্যালার্ট ছিল। ফলে খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তবে খেলাধুলা একসঙ্গেই করতাম। ক্লাসে মাঝেমধ্যে কথাও হতো। তবে সবই একটু দূরত্ব রেখে। কাদেরকে সহজেই আলাদা করা যায় তার চেহারার বিশেষত্বের কারণে। লাল চুল, কিছুটা অশান্ত মেজাজের আর প্রতিবাদী। যেমন- আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ফরহাদ। প্রায়ই এর ওর পেছনে খোঁচাত। এই কারণে ওর নামই দিয়েছিলাম, খোঁচা ফরহাদ। সবাই সাবধানে থাকতাম। ফরহাদ বসতে গেলে পেছনে কলম ধরে রাখত। পেছনে কলম দিয়ে দাগ দিয়ে দিত। এক দিন ফরহাদ কাদেরের শার্টে কলম দিয়ে বিশ্রীভাবে এঁকে দিল। কাদেরের বিষয়টা সহ্য হলো না। সহ্য করার কথাও না। কিন্তু কাদের স্যারের কাছে অভিযোগ না দিয়ে, ঠাস করে ফরহাদের গালের ওপর গোটা কতক থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পড় খেয়ে ফরহাদ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল।

বিচার গেল স্যারের কাছে। স্যার তো রেগে খাপ্পা কাদেরের ওপর। স্যার তো কাদেরের চড় মারাটাই দেখলেন! কাদেরকে দশটা বেত মারলেন। মার খেয়ে কাদের শুধু হাতটা একটু টান করল। যেন কিছুই হয়নি। সময়টা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সারা দেশে তখন উত্তেজনা। কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। আমরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। গ্রামে রাজাকার বাহিনী তৈরি হয়েছে। আমাদের স্কুলের একপাশে ক্যাম্প করেছে। হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে প্রতিদিন। তাদের কাউকে কাউকে ধরেও আনে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে ওরা কয়েকজন দেখতে যায়। রাজাকারের নেতা নজু রাজাকার। ওদের স্কুলও চলে কোনো মতে। ভুপেন স্যার, গোপাল স্যার ভারতে চলে গেছে মিলিটারির ভয়ে। মিলিটারি জিনিসটা যে কী তখনো বুঝিনি। তবে বুঝতাম এই রাজাকারগুলোর চেয়ে ভয়ংকর হবে। ওরা সারাক্ষণ মিলিটারির ভয় দেখাত। মানুষের গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যেত। কাদেরকে বহুবার এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে দেখেছি প্রকাশ্যেই। আমরা বুঝতেও পারিনি যে কাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। ওর হাবভাবে ধরতে পারিনি। এক দিন দুপুরের পর কাদের কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ক্লাসে এসে হাজির হলো। সেদিন কাদের স্কুলে আসেনি। কিন্তু ওর পরনে তখনো স্কুল ড্রেস ছিল।

কি রে কাদের স্কুলে আসিসনি কেন।

সে পরে বলছি। এখন তোরা একটু আমার সঙ্গে আসবি?

কোথায়?

স্কুলের পেছনে জংলা মতো যে জায়গাটা আছে। ওই যে যেখানে কেউ যায়-টায় না। সেখানে।

কেন?

চল না। গেলেই দেখতে পাবি। মাইরি বলছি। তোদের কোনো ক্ষতি হবে না। মাইরি।

আমরা তখন ক্লাসে তেমন কেউ ছিলাম না। তিন-চারজন ছিলাম। গেলাম কাদেরের সথেঙ্গ। জংলা মতো অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে যা দেখলাম তাতে তো আমাদের চোখ চড়কগাছ। এ যে নজু রাজাকারের মৃতদেহ! রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে।

আমরা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম, এ কী করে হলো, কাদের?

শালাকে আমি মারছি। এত দিন বাগে পাইনি। শালা মিলিটারিদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পৌঁছে দেয়। থু। কাদের থু করে একদলা থুথু ফেলল নজু রাজাকারের লাশের ওপর। আমরা কাদেরকে এত দিন ভয় পেতাম না। কিন্তু আজ ওকে কেমন যেন অচেনা মনে হলো। আবার ওর জন্য একটু গর্বও হতে লাগল। যাই হোক, এর ফল ভালো হলো না। পরের দিনই আমাদের স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প করল। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। কাদেরের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তবে শুনেছিলাম কাদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close