অনিন্দ্য আনিস

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪

আবিরের দাদুবাড়ি

প্রকৃতি জুড়ে শীতের রোদন। রাজিব সাহেবের একমাত্র আদরের সন্তান আবির। বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরে থাকে। এই তো কদিন আগে পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন পড়ালেখার জন্য আব্বু-আম্মুর কোনো শাসন তার ওপর চলে না। খাঁচার পাখি আকাশে ডানা ঝাঁপটিয়ে যতটা উচ্ছ্বসিত হয়। এর চেয়েও বেশি এখন আবির আনন্দিত। সে বাঁধনহারা পাখির মতো বাসার মধ্যেই ছুটে বেড়ায়। একা একা বাসায় থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আজ সকাল সকাল আবির বেলকনিতে গিয়ে দূরের আকাশ পানে আনমনে তাকিয়ে আছে। ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে সূর্য উঠেছে। কিন্তু আলোতে কোনো তেজ নেই। চারদিকে অঝোরে শিশির ঝরছে। আবির ভাবছে এই ছুটির দিনগুলো কীভাবে প্রফুল্লময় করা যায়। হঠাৎ দাদুভাইয়ের কথা মনে পড়ল। তার মুখটা চোখে ভেসে উঠল। দাদুভাইয়ের জন্য চোখের কোণে জল জমেছে।

- আম্মু পছন্দের খাবার নিয়ে পাশে দাঁড়াল। বলল, কি হয়েছে আবির? আজ তোমাকে উদাস দেখাচ্ছে কেন? ভেজা কণ্ঠে বলে, আম্মু আমার তো পরীক্ষা শেষ, চলো না, আমরা দাদুবাড়িতে বেড়াতে যাই। দাদুভাইকে দেখতে খুব মন টানছে। আবিরের কথাটা শুনে মায়ের মন খারাপ হয়ে গেল। আম্মু বলল, আবির তোমার আব্বু অফিস থেকে এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তুমি এখন কিছু খেয়ে নাও। শীতের সন্ধ্যায় আব্বু কাচুমাচু হয়ে বাসায় এলো। হাতের ব্যাগটা রাখতে না রাখতেই আবির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাবা বলল, কী ব্যাপার আজ আমার রাজপুত্রের মন খারাপ কেন? আম্মু কি বকুনি দিয়েছে? আম্মু রান্নাঘর থেকে এসে বলল, না অন্য ব্যাপারে আবিরের মন খারাপ।

এই শুনো না, আবিরের তো পরীক্ষা শেষ। আবির বলছিল এই শীতে ওর দাদা-দাদির কাছে বেড়াতে যাবে। এটা আরো ভালো খবর। অনেক দিন ধরে আমরাও যাই না। এই সুযোগে আব্বু-আম্মুকে আমরাও দেখে আসব, আমতা আমতা করে আবার বলল, ‘কিন্তু এখন তো প্রায় বছর শেষের দিকে, কাজের চাপও ভীষণ। দেখি ছুটি নিতে পারি কি না। আব্বুর মুখে যাওয়ার আশ্বাস শুনে আবির খানিকটা আনন্দিত। বেশ কয়েক বছর আগে সে গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। গ্রামের বন্ধু আকিব, আকাশ, কুসুম, সাফিন ওদের কথাও ভীষণ মনে পড়ছে। গ্রামে কাটানো দৃশ্যপট এখনো তার চোখে ভাসছে। আবার নতুন করে শীতের মনোময় পরিবেশ উপভোগ করবে। এই ভেবে আবিরের রাতের ঘুম দুই চোখ থেকে ছুটি নিয়েছে। শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় সে লেপের নিচে শুয়ে গ্রামে গিয়ে কী করবে না করবে এসব কল্পনা করছে। এরই ফাঁকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে বুঝতে পারেনি। অবশেষে রাত কাটিয়ে সকাল এলো। এখনো সূর্য্যরে দেখা মেলেনি। কাচের জানলা গড়িয়ে শিশির ঝরছে। নেই পাখিদের ডাকাডাকি। শীতের চাদরে প্রকৃতি ঢাকা পড়ে আছে।

- আম্মু এসে দেখে আবির এখনো লেপের নিচে নাকমুখ ঢেকে ঘুমিয়ে আছে। আম্মু মৃদুস্বরে বলল, আবির উঠো। তোমার জন্য সুখবর আছে? আবির লাফিয়ে উঠে বলল, রেজাল্ট দিয়েছে? আমরা কী দাদু বাড়ি যাচ্ছি? আব্বু কি অফিস থেকে এসেছে? ছুটি কি পেয়েছে? আম্মু বলল, আগে আমাকে বলতে দাও। আবির বলল, বলো আম্মু বলো তাড়াতাড়ি। আম্মু বলল, তোমার আব্বু অফিসে ফোন দিয়ে ছুটি নিয়েছে। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। তুমি গোসল করে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। সে খুশি মনে আয়নার সামনে তাড়িয়ে দাঁত কিলিয়ে হাসছে। সে হালকা গরম জলে গোসল শেষ করে নতুন জামা গায়ে পরিধান করে নিল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে নিল। ঘুগরাকাটি লঞ্চের উদ্দেশে খুলনার লঞ্চঘাটে গেল। আব্বু তিনটে টিকিট কেটে নিয়ে এলো। আবির বায়না ধরল জানলার পাশে বসবে। তার কথামতো আব্বু জানলার পাশে বসতে দিল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর লঞ্চ আবিরের দাদু বাড়ির উদ্দেশে নদীর বুক চিড়ে ক্রমশ আগাতে লাগল। সাদা বকের দল লঞ্চের পিছু নিয়ে উড়ে যায় আকাশে। এই মনোরম দৃশ্যে আবির বারবার হারিয়ে যায়। কুয়াশায় দূরের গাছগাছালি পাহাড় মনে হয়। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা লঞ্চ চলতে চলতে ঘুগরাকাটি লঞ্চঘাটে, লঞ্চ ভিড়ে। আব্বু ব্যাগপত্র নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে, আবিরের হাত ধরে আম্মু পাড়ে গেল।

- ঘুগরাকাটি গ্রামের মাটিতে পা রাখতে না রাখতেই আবিবের মনে এক অন্যরকম অনুভব হলো। গ্রামের মাঠ জুড়ে শস্যখেত, হলুদ ফুলের ঘ্রাণে মন ব্যাকুল হয়ে উঠছিল। ঘুগরাকাটি থেকে আবিরের দাদুবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৭/৮ কিলোমিটার। তাই আব্বু একটা ভ্যানগাড়ি ডেকে আনলো। সেই গাড়িতে করে আবির দাদুবাড়ির পথ ধরে চলছে। গরুর পাল মাঠে এক জুটে ঘাস খাচ্ছিল। ফিঙে পাখি মাথায় বসে মনের আনন্দে নাচছে। এসব দেখতে দেখতে রাস্তা ফুরিয়ে গেল। একসময় বাড়ির উঠোনে গাড়ি থামল। আব্বু-আম্মু দাদুভাইকে ডেকে বাড়ি মাথায় তুলছে। দাদুভাই লাঠি ভর করে সাবধানে পা ফেলে ফেলে সামনে আসল। আব্বু-আম্মু দুজন সালাম দিল। আব্বু দাদুভাইকে জড়িয়ে ধরল। দাদুভাই আনন্দে আত্মহারা। কাঁশতে কাঁশতে বলছে, রাজিব আমার দাদুভাই কোথায়? দেখি আমার দাদুভাই কত বড় হয়েছে? কতদিন ধরে দেখি না। আবির আম্মুর পেছন থেকে গিয়ে বলল, দাদুভাই এই তো আমি। দাদুভাই বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আমার দাদুভাইটা কত্ত বড় হয়ে গেছে। আব্বু ব্যাগপত্র রেখে দাদুভাইকে বলল, আব্বু জালটা কোথায়? দেও তো দেখি কত দিন ধরে মাছ ধরি না। দাদুভাই বলল, রাজিব এই ঠাণ্ডা পানিতে তোমাকে মাছ ধরতে হবে না। গতকাল পুকুর থেকে অনেক মাছ ধরা হয়েছে। তোমরা এসে ভালো করছো। এত মাছ আমি কি একা খেতে পারি, ছেলে, বউ ও নাতিকে কাছে পেয়ে দাদুভাইয়ের আনন্দের সীমা নেই।

দাদুভাই আবিরকে নিয়ে গল্পে মেতে উঠেছে। ওইদিকে আম্মু নিজ হাতে নানা রকমের সুস্বাদু খাবার রান্না করছে। একসময় সবাইকে খেতে টেবিলে ডাকে। দাদুভাই আর আবিরের মধ্যে বিরামহীন খুনসুটি চলছে। খাওয়ার পর সবাই একত্রে বসে গল্পগুজব করতে লাগল। শীতের বিকেলে দাদুভাই একমাত্র নাতি আবিরের হাত ধরে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে যায়। রাস্তার পাশের পুকুরে দেখিয়ে বলল, এই পুকুরে তোমার আব্বু ছোটবেলা কত মাছ ধরেছে। ওই দূরের ঘন ঘাসের মাঠে আমি, তোমার আব্বু, তোমার কাকা এরা ফুটবল, ক্রিকেট খেলেছি। ওই দূরের মাদরাসায় তোমার আব্বু আরবি হরফ শিখেছে। দাদুভাই ওই যে জামে মসজিদটা দেখছো এখানে আমরা নামাজ আদায় করি। তুমিও পড়বে নাকি? এই মসজিদে আমার বাবা-দাদার শরীরের স্পর্শ এখনো লেগে আছে। দাদুভাই আবিরকে নিয়ে গেল তাদের পারিবারিক কবরস্থানে যেখানে সমাধি দেওয়া হয়েছে তার বাবা, দাদা, চাচা, মা চাচিদের। আবির বাবা, দাদার শৈশব কাটানোর স্থান দেখতে পেয়ে বেজায় খুশি। দাদুভাই আবিরকে বলল, দাদুভাই ওই যে ঘুগরাকাটি সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়টা দেখছো এই স্কুলে আমিও পড়ালেখা করেছি এবং তোমার আব্বুও করেছে। আবির আরো বেশি আনন্দ পায়। বাবা-দাদা যে স্কুলে পড়েছে সেই স্কুল দেখতে পেয়ে। গোধূলি কাটিয়ে সন্ধ্যার আকাশ আবারও কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তাই বাড়িতে চলে আসে। গ্রামের মানুষ সরল প্রকৃতির হয়ে থাকে। শহর থেকে আত্মীয়স্বজন এলে দাওয়া করে খাওয়ার কলরোল পড়ে যায়। বেশ কয়েকটা বাসায় সন্ধ্যাবেলা দাওয়াত খেয়ে এলো। শীতের রাতে শরীর গরম রাখতে ব্যাডমিন্টন খেলা খুব জমে ওঠে। বাড়ির উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলছে বাবা-দাদুভাই। দাদুভাই মাঝেমধ্যে আবিরকেও খেলার সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে খড়ের আগুনে আম্মু খোলা আকাশের নিচে বসে পিঠাণ্ডক্ষীর-পায়েস, পিঠাপুলি, রসের পিঠা, তেলে পিঠা, পাটিসাপটা এবং ভাপাসহ নানা রকম পিঠা তৈরি করছে।

- খেলা শেষ করে সবাই পিঠা খেতে উনুনের পাশে বসল। দাদুভাই আবিরকে ভয় দেখাতে বানিয়ে বানিয়ে ভয়ানক ভূতের গল্প বলে। আবির ভয়ে দাদুভাইকে জড়িয়ে ধরে। তা দেখে আব্বু আম্মু বলে দেখো বোকা ছেলের কাণ্ড। আম্মু যত্নসহকারে সবাইকে পিঠা খেতে দিল। শীতের রাতে গরম পিঠা খাওয়ার মজাই অন্যরকম। পিঠা খাওয়ার জন্য রাতে কেউ ভাত খায়নি। গ্রামে রাত ৯টার সময় মনে হয় মধ্যরাত। ৯টার দিকেই গ্রামের পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। গ্রামীণ পরিবেশে এসে তারাও ৯টার সময় ঘুমাতে গেল। সূর্য সকালে অনেক দেরিতে ওঠে। এই শীতের সকালেই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ করতে যায়। ভোরের কুয়াশা ঠেলে গাছিরা খেজুরগাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করে। দাদুভাই আবিরকে সকাল সকাল উঠিয়ে হাঁটতে নিয়ে গেল। দেখতে পেল রাস্তার পাশে জোয়ান বুড়ো সবাই মিলে খড়ের আগুনে দেহ গরম করছে। দাদুভাই আবিরকে সেখানে নিয়ে যায়। শরীর গরম হলে আবারও হাঁটতে যায়। গাছির খেজুর রসের হাঁড়ি নামাতে দেখে আবির দাঁড়িয়ে যায়। দাদুভাইকে বলল, দাদুভাই হাঁড়িতে কী? দাদুভাই বলল, তুমি জানো না? এই হাঁড়িতে খেজুরের রস। আবির বলল, আমি খেজুরের রস খাবো দাদুভাই। দাদুভাই গাছিকে কাছে ডাকল। সে বলল, এক হাঁড়ি ফ্রেশ রস দাও তো। আমার শহুরে দাদুভাই খাবে। গাছি ছেঁকে এক হাঁড়ি খেজুরের রস খেতে দিল। আবির তৃপ্তির সঙ্গে গবগব করে খেয়ে নিল।

- এভাবে আবির আর দাদুভাইয়ের খুনসুটির মধ্য দিয়ে কেটে যায় এক সপ্তাহ। হঠাৎ করে বাবার মোবাইলে মেসেজ আসে। আবির লটারির মাধ্যমে জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে! সে খুশিতে সবাই আত্মহারা। নতুন বছরের নতুন খবর। তার পরও আবিরের মন খারাপ, দাদুভাইকে ছেড়ে আবারও শহরে চলে যাওয়ার কথা শুনে। আব্বু-আম্মু খুব করে বুঝিয়েও আবিরের মন ভালো করতে পারছে না। তাকে দাদুভাই বলল, মন খারাপ করো না। তোমার বাবার মতো তোমাকেও যে বড় অফিসার হতে হবে। যেদিন বড় অফিসার হতে পারবা, সেদিন আমি একেবারে তোমার কাছে চলে যাব। এই কথায় তার মন ভালো হয়ে যায়। দাদুর থেকে বিদায় নিয়ে তারা আবারও ভ্যানগাড়িতে চড়ে ঘুগরাকাটি লঞ্চঘাটে যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লঞ্চ খুলনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। নদীর বুক চিড়ে দুপাশে জল উপচে পড়ছে। কী চমৎকার লাগছে জলখেলানো! গাছগাছালি মাঠঘাট পিছু রেখে ছুটতে লাগল। আবিরের চোখে দাদুভাইয়ের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো স্বচ্ছ জলের মতো ভেসে উঠছে। বাবা বুকে টেনে নিয়ে বলে আবারও শীতের সময় তোমার দাদুভাইয়ের কাছে আমরা আসব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close