মো. আশতাব হোসেন

  ০৬ জানুয়ারি, ২০২৪

সার্কাসের হাতি

বনের নাম দোলপোড়া। কয়েকবার দাবানল হয়ে বন প্রায় সাবাড় হয়ে গেছে। খালি পড়ে আছে মাঠের পর মাঠ। তবুও বনের একপাশে কিছু গাছপালা রয়ে গেছে। সেই অংশটুকুতে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে এক জোড়া হাতিরও বসবাস, তাদের সঙ্গে আছে ছয় মাস বয়সের এক শাবক। পুরুষ হাতিটির নাম বলংবাহাদুর, তার স্ত্রীর নাম বিলাসুমা এবং ছোট বাচ্চাটির নাম জলিরাজ। দাবানলে পুড়ে যাওয়া বনে নেই উপযুক্ত সব খাবার; এর ফলে না খেয়ে খেয়ে সবার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেেেছ। কী করবে হাতি দম্পতি! চিন্তা করে করে তাদের দেহ শুকিয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাটাও ঠিকমতো খাবার না পেয়ে কঙ্কালসার অবস্থা।

এক দিন শাবকসহ হাতি দম্পতি বনের পাশ দিয়ে হাঁটছে আর দেখছে, কোথাও কোনো কলাগাছ বা অন্য কোনো গাছের পাতা পাওয়া যায় কি না। হঠাৎ তাদের চোখে পড়ল বনের পাশ দিয়েই কাঁচা রাস্তা দিয়ে প্রাতর্ভ্রমণ করছে এক লোক। লোকটি ছিল মূলত এক সার্কাস দলের মালিক। তাকে দেখে ভয়ে ভয়ে হাতি দুটি তার দিকেই এগিয়ে এসেই শুঁড় উঁচিয়ে যেন কিছু একটা ইঙ্গিত করছে। সার্কাসের মালিক অপেরাসোম দীর্ঘদিন বিভিন্ন প্রাণীকে ছোট থেকে ট্রেনিং দিয়ে সার্কাসের খেলা দেখানোর উপযুক্ত করে তাদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখিয়ে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। অপেরাসোম নিজেও প্রাণীদের ভাব ভাষা বোঝার ক্ষমতা রপ্ত করেছে।

তাই অপেরাসোমের বুঝতে বাকি রইল না যে হাতিরা কি বলার চেষ্টা করছে এবং তার দিকে কেন শুঁড় উঁচু করেছে। সেই মুহূর্তেই সে বাড়ি গিয়ে বেশ কটি কলাগাছ পাতাসহ কেটে ফেলে। তারপর বাড়ির কাজের লোক দিনেশসহ একটি ঠেলাগাড়ি করে বনের ধারে সেই হাতিদের কাছে যায়। হাতিগুলোও বুঝতে পেরেছিল যে অপেরাসোম তাদের কষ্টের কথা বুঝতে পেরেছে এবং তাদের প্রতি দয়া করে কলাগাছ নিয়ে এসেছে।

অপেরাসোম দিনেশকে কলাগাছগুলো রাস্তার নিচে রাখতে হবে বলে নিজের সঙ্গে ধরাধরি করে সবগুলো কলাগাছ রাস্তার পাশে রেখে একটু দূরে গিয়ে দিনেশকে বলে তুমি বাড়ি চলে যাও, আমি পরে আসছি। হাতিরা একপা দুপা করে কলাগাছের কাছে চলে এসে খাওয়া শুরু করে দেয় এবং শাবকটিকেও কলাগাছ খাওয়ানো শেখায়। কয়েক দিন যেতে না যেতেই হাতিরা অপেরাসোমের খুব আপন হয়ে যায়। শাবকটিকেও অপেরাসোম আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়। শাবকটার ভয় ভেঙে গিয়ে অপেরাসোমের আপন সন্তানের মতো হয়ে যায়।

এক দিন বলংবাহাদুর ও তার সঙ্গী শাবক জলিরাজের কানে কী যেন চুপে চুপে বলে দিয়ে তারা দুজন বনের ভেতরে চলে যাচ্ছিল, তখন শাবক জলিরাজ চুপ করে সেখানেই বসে রয়। এই অবাক করা কাণ্ড দেখে অপেরাসোম বুঝে ফেলে যে বাচ্চাটিকে মনে হয় ওদের বাবা-মা আমাকে দত্তক দিয়ে চলে যাচ্ছে। বাচ্চাটিও মনে হয় আমার কাছে থাকার জন্য খুবই আগ্রহী। অপেরাসোমও বুঝতে পারে দাবানলে পুড়ে যাওয়া বনে ক্ষুধার্ত হাতি দুটো নিরুপায় হয়ে শাবকটিকে রেখে যায়।

এই ভেবে অপেরাসোম শাবকটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, চল চল আমার সঙ্গে। এখন থেকে তুই আমার বাড়িতেই থাকবি। এই বলে অপেরাসোম বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলে শাবকটিও তার পিছে পিছে রওনা দেয়। শাবকটিকে বাড়িতে এনে অপেরাসোম ভালো করে গোসল করিয়ে বেশ কিছু কচি কলাগাছ খেতে দেয়। জলিরাজ মহাখুশিতে কলাগাছ খায়।

এদিকে অপেরাসোম দিনেশকে বলে দেয় প্রতিদিন সকালে বনের সেই বড় হাতি দুটিকে কিছু কিছু কলাগাছ দিয়ে আসতে। দিনেশ মালিকের কথামতো কাজ করতে থাকে। হাতি দুটি শাবক দত্তক দেওয়ার বিনিময়ে নিয়মিত খাবার পেয়ে অনেক খুশি। তারা বুঝতে পারে বাচ্চাটার দিন ভালোই কাটছে। শাবকটি দিন দিন নাদুসনুদুস হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে তাকে বিভিন্ন সার্কাস প্রতিযোগিতায় খেলা দেখানোর জন্য প্রশিক্ষণও দিচ্ছে অপেরাসোম।

এভাবে অপেরাসোমের প্রশিক্ষণ নিয়ে এক দিন জলিরাজ সার্কাসের এক শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। দিগবিদিক তার সুনামের খ্যাতি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সার্কাসে খেলা দেখাতে দেখাতে জলিরাজ অপেরাসোমের সার্কাস দলকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। অপেরাসোম সার্কাসের আয় দিয়ে রাতারাতি বিত্তশালী হয়ে যায় এবং তার ভেতরে আর পাওয়ার নেশা পেয়ে বসে। সার্কাসের পাশাপাশি বাড়তি টাকার লোভে জলিরাজকে দিয়ে অপেরাসোম অনেক কাজ করিয়ে নিতে শুরু করে। এক দিন চিনিভর্তি এক ট্রাক ভাঙা রাস্তায় চলতে গিয়ে খাদে পড়ে যায়। ট্রাক ড্রাইভার অপেরাসোমের কাছে গিয়ে জলির সাহায্যে ট্রাকটি তুলে দিতে চুক্তি করে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে।

লোভী অপেরাসোম জলিকে নিয়ে লোহার শেকল দিয়ে ট্রাকের এক পাশে বেঁধে জলির গলায় শিকল পরিয়ে দেয়। জলি তার মনিবের মন রক্ষার জন্য জানে-প্রাণে ট্রাকটি খাল থেকে ওপরে তুলে আনার পরেই গলার শেকল ছিঁড়ে গিয়ে পা ফসকে সহসা রাস্তার ভিন্ন প্রান্তের খাদে গিয়ে পড়ে এবং পা ভেঙে যায়। ট্রাক তুলে দিয়ে জলি নিজেই পঙ্গুত্ব বরণ করে খাদে পড়ে থাকে। এবার হৃষ্টপুষ্ট জলিকে কে তুলবে?

জলিকে আর সেখান থেকে তুলতে না পেরে অপেরাসোম তার কাজের লোক দিনেশকে বলে প্রতিদিন জলিকে কিছু কিছু কলাগাছ এনে দিতে খাওয়ার জন্য। এভাবে কিছুদিন জলিরাজ মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ওপারে চলে যায়। জলিরাজবিহীন সার্কাস আর আগের মতো জমেনা। লোকও আগের সার্কাস দেখতে ভিড় করে না। ধীরে ধীরে অপেরাসোম লোকসান গুনতে গুনতে পথে বসে যায়। একপর্যায়ে জমাজমি সব বিক্রি করে বৃদ্ধ বয়সে রাস্তার ভিখারি হয়ে যায়। ‘লোভ যখন কাউকে বসে পেয়ে/জীবন তার চলে যায় না খেয়ে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close