সাদিক আল আমিন

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

শালবাগানের রহস্য

স্কুলে আসতে আজ একটু দেরি হলো সিফাতের। রাকিব অনেক আগে এসেই বসে আছে শেষের বেঞ্চে। সিফাতের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল একা একা। কালরাত্রের ঘটনাটা ওকে অনেক আতঙ্কিত করে রেখেছে। কখন যে কথাটা সিফাতের কাছে পাড়বে সেই অপেক্ষাতেই অধীর হয়ে ওঠে রাকিব। সিফাতকে দরজার সামনে দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। যাক, কথাটা তাহলে আর বেশিক্ষণ পেটে চাপিয়ে রাখতে হচ্ছে না। রাকিব সিফাতকে ইশারা করায় সিফাত ওর পাশে গিয়ে বসে। রাকিবের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে সিফাত বলে, ‘তুই কি কিছু বলতে চাস?’ রাকিব মাথা নাড়ায়। ‘তাহলে বল!’ ‘থাম একটু পানি খেয়ে নেই। গলাটা শুকিয়ে গেছে।’ ব্যাগ থেকে পানির পট বের করে পানি খায় সে। ভাবে, কীভাবে ব্যাপারটা সিফাতকে বলা যায়! সিফাত কি তার কথা বিশ্বাস করবে? নাকি আবার উড়িয়ে দেবে? আমতা আমতা করতে করতে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে রাকিব-

‘শোন তাহলে’ ‘হ্যাঁ রে বল। একটা কথা বলতে এত সময় লাগে?’ ‘আরে এটা সাধারণ কথা নয়। পুরাই ধাঁধানো ব্যাপার। শুনলে চমকে যাবি’ ‘আগে বল তো! তারপর দেখা যাবে চমকাই কিনা’ ‘সেদিন আমাদের বাসায় মানিক কাকু এসেছিল। মানিক কাকু হলো আমার বাবার দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই। বাড়ি নোয়াখালীতে। আমাদের বাড়িতে ঈদের ছুটিতে এসেছিল।’

‘কেন? তোর কাকুর গ্রামের বাড়ি নেই? তোদের বাড়িতে কেন এসেছিল? ঈদের ছুটিতে কি কেউ নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে ঈদ করতে যায়!’ ‘না নেই গ্রামের বাড়ি। দাদু মারা যাবার পর সব অন্যের দখলে চলে যায়।’ ‘তারপর কী হলো বল।’

তো যেদিন মানিক কাকু বাসায় এলো আমি সেদিন স্কুলে আসিনি। জ্বর ছিল। বিকেলের দিকে জ্বর সেরে একটু ঘাম ঘাম ভাব হলে মা বলল, মানিক কাকুর সঙ্গে শালবাগানের দিকটা একটু বেড়িয়ে আসতে। একটু রিলেক্সও হবে। আর মানিক কাকুকে জায়গাটা দেখানোও হবে। আমি নিমরাজি হয়েও পরে রাজি হলাম। মানিক কাকু নাকি মজার মজার কয়েকটা কিশোর উপন্যাস এনেছে। সেগুলো দেওয়ার লোভ দেখাল। তাই আর না করতে পারলাম না।’ ‘তারপর কি হলো? শালবাগানে গেলি?’ ‘হ্যাঁ গেলাম তো। সেটা আবার আরেক কাহিনি।’

‘বল তাহলে শুনি’ এমন সময় রতন স্যার ক্লাসে ঢুকল। রাকিবদের স্কুলের একটা পরিচিত নাম ‘রতন স্যার’। সবাই এক নামে চেনে। নীতিবাক্য বলা আর উপদেশ দেওয়ার বেলায় তার জুড়ি নেই। অনেক অভিজ্ঞ ও মেধাবীও তিনি। মাঝে মাঝে কানমলাও দেন। স্যারের চলে আসায় আর বাকিটুকু বলতে পারল না রাকিব। সিফাত বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ধুত্তোরি, গল্পটা জমে আসছিল আর এ সময় ডিস্টার্ব।’ অগত্যা তাদেরকে স্যারের লেকচার শুনে যেতে হলো চুপচাপ বসে। টিফিন পিরিয়ডে তাড়াতাড়ি টিফিন শেষ করে সিফাত আর রাকিব স্কুল মাঠের এক কোনায় দেয়ালে এসে বসল। সিফাত বলল, ‘তারপর কী হলো রে?’ রাকিব বলতে শুরু করল, ‘আমি আর মানিক কাকু শালবাগানে যাওয়ার জন্য একটা রিকশা ভাড়া করলাম। রিকশার ভাড়া যেখানে ১০ টাকা, সেখানে রিকশাওয়ালা ৩০ টাকা চাইছিল। তো, এটা নিয়ে কাকুর সঙ্গে রিকশাওয়ালার এক দফা ঝগড়া হলো। শেষমেশ ১৫ টাকা ভাড়া ঠিক করে আমরা চেপে বসলাম রিকশায়।’

সিফাত আগ্রহ নিয়ে রাকিবের কথা শুনে যেতে লাগল। যেন খুব একটা ইন্টারেস্টিং স্টোরি হতে যাচ্ছে। সিফাত বলল, ‘তারপর কী হলো? রিকশায় করে শালবাগানে গেলি?’ ‘হুম। শালবাগানে যেতে যেতে তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। রিকশাটা শালবাগানে যখন পৌঁছাল তখন মাগরিবের আজান দিচ্ছে।’ ‘তখন কী হলো?’ উৎকণ্ঠা সিফাতের চোখেমুখে। রাকিব বলতে লাগল, যেহেতু জায়গাটা আমার চেনা আর বাসা থেকে বেশি দূরে না, তাই আমার কিছু মনে হলো না। কিন্তু মানিক কাকুর ভয় করছিল। না তোর মানিক কাকু ভয় পেল আর তুই ভয় পেলি না? তাজ্জব ব্যাপার! ‘আরে কোনো তো আগে পুরোটা! তো মানিক কাকু আমাকে বলছিল যে এ জায়গায় আগে এসেছি কিনা। আমি বললাম যে অনেকবার এসেছি। নাহলে কী আর তাকে নিয়ে আসতে পারতাম!’ ‘তারপর মানিক কাকু কী বলল?’ রিকশা থেকে নামার পর মানিক কাকু বলল তার নাকি ভয় করছে! আমি কাকুর কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আরে কাকু তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি আছি তো। কিছু হবে না। এ জায়গাটায় আমি বহুবার এসেছি। একদম সব চেনা’ মানিক কাকু তখন যেন ভয়ে কাঁপছে। আমাকে বলল, ‘রিকশাওয়ালাটাকে দেখ’। আমি রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম।’ সিফাত শুনেই প্রায় ভয় পেয়ে বলল, ‘কেন? রিকশাওয়ালাটার দিকে তাকাতে বলেছিল কেন? কী হয়েছিল? তুমিই তাকিয়েছিলি? কী হলো বল না!’ রাকিব একটু ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করল, ‘রিকশাওয়ালাটার দিকে যখন আমি তাকাই তখন দেখি রিকশাওয়ালাটার চোখ দুটো কালো হয়ে গেছে। পুরো চোখ কালো। চোখের সাদা অংশটাও কালো হয়ে গেছে।’

‘তারপর কী হলো রে?’ ‘কাকু রিকশাওয়ালাকে ভাড়া চুকিয়ে দিলেও রিকশাওয়ালাটা সেখান থেকে যাচ্ছিল না। আর কালো চোখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে সে। একটুও নড়ছে না। দেখলে মনে হয় যেন কিছুই দেখছে না।’ ‘তখন কী করলি? পালিয়ে বাড়ি চলে এলি?’ নাহ। আমি কাকুকে আর নিজেকে মনে মনে সান্ত¡না দিতে থাকলাম। কাকুকে বললাম, ‘অন্ধকারে আমরা হয়তো ভুল দেখছি। একটু পরেই চলে যাবে। চল কাকু আমরা শালবাগানের ভেতরটা দেখি।’ সিফাত প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, ‘বলিস কী রে! রাতের অন্ধকারেও তোরা শালবাগানে গিয়েছিলি?’ না গিয়ে উপায় কী ছিল বল! কাকুকে শালবাগানটা দেখাতে পারলেই না তবে নতুন মলাটের বইগুলো হাতে আসবে! কাকু অবশ্য ভয়ে আমতা আমতা করছিল। যাবে কি যাবে না, এটা সে বুঝতে পারছিল না। আমি প্রায় জোর করে কাকুকে টেনে নিয়ে গেলাম। কাকুর পকেটে থাকা টর্চটা জ্বালালাম। শালবাগানের ভেতরে ঢুকেই দেখি আরেক কান্ড। কী কান্ড? মজার না ভয়ের? বলত কী হলো। রিংরিং করে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। টিফিন পিরিয়ড শেষ। সিফাত বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘দুর ছাই। কিছুই ভালোমতো শুনতে পারলাম না। ছুটির পরে শুনাইস।’ রাকিব মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। টিফিনের পরে এখন শাহেদ স্যারের ক্লাস। একজন কড়া অঙ্ক শিক্ষক। হোমওয়ার্ক করে না নিয়ে এলে সবাইকে পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেয়। রাকিব আর সিফাত হোমওয়ার্ক করে আনেনি। টিফিনের সময়টাতে ক্লাসে বসে বাড়ির কাজগুলো করার কথা ছিল কিন্তু গল্পের তালে আর কিছুই হলো না। দুজনে বুকে ভয় নিয়ে ক্লাসরুমে যায়। আজ আর রেহাই নেই স্যারের হাত থেকে।

স্কুল ছুটির পর সিফাত রাকিবকে ডেকে থামতে বলে। সিফাত বলল, আমাকে ওই শালবাগানটাতে নিয়ে যাবি?

রাকিব চোখ সরু করে সিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই গিয়ে কী করবি? যাব দেখতে জায়গাটা। নিয়ে চল না! রাকিব একটু ইতস্তত করে বলল, যদি কোনো সমস্যা হয়? আমার তো ওদিকে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ভয় হচ্ছে। যদি আবার কিছু হয়! সিফাত রাকিবকে নির্ভার করে। বলে, দিনের বেলায় কিছু হবে না। যদি কোনো সমস্যা হয় চেঁচিয়ে লোক ডাকব। চল আমাকে নিয়ে। যেতে যেতে বাকি কাহিনিটা বল। শালবাগানের ভেতরে ঢুকে তখন কি কান্ড ঘটল? ভূত ঘাড় মটকে দিল নাকি? রাকিব দম নিয়ে বলতে শুরু করল আবার-

টর্চলাইটের আলোতে কাকু আর আমি ধীরে ধীরে বাগানের রাস্তা ধরে হাঁটছি। এমন সময় আমাদের দুজনেরই চোখ পড়ল হাত কয়েক দূরে। দেখতে পেলাম যে, একটা মরা লাশের ওপর অনেকগুলো ব্যাঙ চড়ে লাশের শরীর থেকে মাংস কামড়িয়ে খাচ্ছে। সর্বনাশ! ওটা কি মানুষের লাশ ছিল? স্পষ্ট দেখেছিলি? রাকিব একটু থেমে বলে, হ্যাঁ মানুষেরই লাশ ছিল। অনেকগুলো ব্যাঙ একটা মানুষের লাশ খুলে খুলে খাচ্ছে। ভাবতে পারিস!

সিফাত ইইই বাবা! বলে উঠল। রাকিব বলল, সেটা দেখে তো আমার আর মানিক কাকুর অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা প্রায়। তখনি সঙ্গে সঙ্গে আমরা উল্টো দৌড় দিলাম।

এক দৌড়ে বাড়ি চলে এলি? না। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। মানিক কাকু আরো ভয় পেয়ে যায়। আমাকে তাড়াহুড়ো করে উঠাতে গিয়ে সেও মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তখন মিশমিশে অন্ধকার চারদিকে। টর্চলাইটের আলো কমে আসছে। ব্যাটারি শেষ প্রায়। আমি যেন সংজ্ঞা হারাই এমন অবস্থা। ভয়ে প্রায় পুরো শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছিল। খুব কষ্ট করে আমি আর মানিক কাকু উঠে দাঁড়ালাম। যে করেই হোক তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে। কে জানে কখন যে ওই মানুষখেকো ব্যাঙগুলো আমাদেরকেই খেয়ে ফেলে! কী হলো তখন? রাকিব থমথমে গলায় বলতে লাগল, আমরা যখন পড়ে যাই তখন শালবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি। উঠে দাঁড়াতেই দেখি সেই রিকশাওয়ালাটা মাথা ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে মানে? মানে ঘাড়ের ওপরে মাথা নেই। ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর নিস্তেজভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নেই। তুই কী আমার সঙ্গে ফাইজলামি করছিস রাকিব? আমাকে বানিয়ে বলছিস? ব্যাঙের কথাটা না হয় মেনে নিলাম যে ব্যাঙগুলো খুব ক্ষুধার্ত ছিল বলে কোনো উপায় না পেয়ে মরা মানুষের লাশ থেকে মাংস খুলে খেয়েছে। কিন্তু রিকশাওয়ালার মাথাটা হঠাৎ নাই হয়ে যাবে কেন? মজা করছিস আমার সঙ্গে? রাকিব বলে, আরে না না। তোকে আমি বানিয়ে বলতে যাব কেন? যা বলছি সব সত্যি। বিশ্বাস না হলে আমাদের বাড়িতে গিয়ে মানিক কাকুকে জিজ্ঞেস করবি চল। আচ্ছা বিশ্বাস করলাম তোর কথা। তুই তো অন্তত মিথ্যা বলিস না কারো কাছে। এটা আমি জানি। কিন্তু বিষয়টা ভেবে দেখেছিস একবার? ইশ, কী ভয়ংকর! ভাবা যায়!

ভয়ে তো আমার আর কাকুর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। কী করে যে সেদিন সেখান থেকে বেঁচে ফিরলাম কে জানে! মাথাহীন রিকশাওয়ালাকে দেখে তখন কী করলি? একটা মানুষের আস্ত মাথাটাই নাই। এ রকম আমি কখনো ভাবতে পারিনি। আমার তো জান যায় যায় অবস্থা। মানিক কাকু কোনোমতে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে থাকে। আমি তখন প্রায় অবচেতন। চোখ অর্ধেক বন্ধ করা আছে। তন্দ্রা আসলে যেমন হয়। তেমন আধবোজা চোখে আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেকগুলো ব্যাঙ আমাদের পিছু পিছু লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে।

ইয়া বাপ রে! তারপর কী হলো রে? অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে সিফাত জিজ্ঞেস করে।

আমি সেটা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সকালে জ্ঞান ফিরলে দেখি মা, বাবা আর কাকু বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাকুর দিকে তাকাই। বেচারার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। সেই রাতটা আমার আর কাকুর জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রাত ছিল। উফ! যাক, বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছিস। কাকু তোকে নিয়ে দৌড় না দিলে ব্যাঙগুলো মনে হয় তোদেরকেও খেয়ে ফেলত। কী ভয়ংকর! শুনেই আমার গা শিরশির করে উঠছে। রাকিব আর সিফাত তখন শালবাগানে এসে পৌঁছেছে। প্রায় বিকেল হয়ে গেছে তখন। একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যা নামবে; তারপর রাত হবে। সিফাত দেখতে চাইল কোনো জায়গায় ঘটনাটা ঘটেছিল; রিকশাওয়ালাটা কোনো জায়গায় মাথাকাটা অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। আর কোনো জায়গাতে ব্যাঙগুলো একটা মরা মানুষের লাশ থেকে মাংস খুলে খুলে খাচ্ছিল! রাকিব কিছুই বলতে পারল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে, অনেকগুলো রাক্ষুসে ব্যাঙ যেন লাফিয়ে লাফিয়ে তার দিকে আসছে। তার চোখ দুটো যেন আধবোজা হয়ে আসছে। তন্দ্রার মতো ভাব। এক্ষুনি যেন সে জ্ঞান হারাবে!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close