আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

একুশে ফেব্রুয়ারি

আগামীকাল একুশে ফেব্রুয়ারি। দিনটি কীভাবে পালন করবেÑ এ নিয়ে দুই বন্ধুর বেশ জল্পনাকল্পনা চলছে। অনেক আলাপ-আলোচনা শেষে তারা মোটামুটি একটি কর্মসূচি তৈরি করেও ফেলে। কিন্তু গোল বাধল তন্ময়ের আগমনে। সে সরাসরি বলে ফেলল, ‘দেখ! তোমাদের কর্মসূচির সঙ্গে আমি একমত নই। ফুলের তোড়া নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া, ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রভাতফেরিতে বের হওয়া, আজিমপুর গোরস্তানে গিয়ে নীরবতা পালন করার ইচ্ছে আমার নেই।’

তন্ময় তাদের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনজনে প্রায় মিলেমিশে থাকে। কথার মাঝখানে নির্ঝর বাধা দিয়ে বলল, ‘আরে তুমি কি পাগল হয়েছো? তুমি জানো না যে, ১৯৫২ সালের এমন এক দিনে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করেছে!’

তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ জানি। আর সে কারণেই এ দিনটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। শপথ নেওয়ার দিন বলে বিশ্বাস করি। তবে তোমরা যেভাবে ভাবছো, সেভাবে পালন করার পক্ষপাতি নই আমি।’ আসলে কর্মসূচি গ্রহণের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব কোনো চিন্তা বা যুক্তি ছিল না। তাই অন্যান্যদের দোহাই দিয়ে রানা বলল, ‘তাহলে তুমি কি বলতে চাও? অন্যরা যা করছে তা ভুল, ঠিক নয় কি? তন্ময় বলল, ‘না, আমি তা বলছি না। তবে অন্যান্যরা যা করে তাই যে ভালোÑ এ কথা কে বলল? ছাত্রদের মধ্যে অনেকে আছে লেখাপড়া না করে আড্ডা মেরে বেড়ায়। তাই বলে কি তুমিও তাদের মতো পথ ধরতে চাও?’

রানা আর নির্ঝর তন্ময়ের এ প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পায় না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে ওরা বলল, ‘তুমি কীভাবে দিনটি কাটাতে চাচ্ছো?’ জবাবে তন্ময় বলল, ‘তেমন কিছু এখনো ভাবিনি। তবে আমি ফজরের নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত করে রফিক সালাম বরকতসহ সব পরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দোয়া করব।’

এতক্ষণে রানা যেন চিন্তার খোরাক পেল। তন্ময়ের কথা শেষ হতে না হতেই সে বলে উঠল, ‘আচ্ছা নামাজ শেষে আজিমপুর গিয়ে কবর জিয়ারত করলে কেমন হয়?’ নির্ঝর যেন এ প্রস্তাব সহজেই মেনে নিতে পারল না। সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘বুঝলাম যে তোমরা শহীদ মিনারে গেলে না, প্রভাতফেরিতেও যোগ দিলে না। কিন্তু গোরস্তানে গিয়ে ফুল বা নীরবতা পালন না করে কবর জিয়ারতে লাভটা কী?’

নির্ঝরের কথায় রানা যেন একটু বিব্রতবোধ করে। কি যুক্তি যে সে দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। অবশেষে তন্ময়েরর কথায় সে যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তন্ময় বলল, ‘ধর্মীয় নির্দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমার মনে হয়, অন্য কারণেও এর গুরুত্ব আছে। ভয়ে, আনন্দে, বিস্ময়ে, অসাধ্য সাধনে কি আমরা কখনো নির্বাক নিশ্চুপ থাকি? নিশ্চয় নয়। ঠিক তেমনিভাবে শহীদদের ক্ষেত্রে আমরা নীরব থাকতে পারি না। তাদের আত্মত্যাগের জন্য আমরা দুহাত তোলে প্রার্থনা করতে পারি, নতুনের শপথ নিয়ে নতুনত্ব দিয়ে দিনটি শুরু করতে পারি।’ নির্ঝর আর প্রতিবাদ করে না। মাথা নেড়ে এ প্রস্তাবকে স্বীকার করে নেয়।

এদিকে রানার আর বিলম্ব সইছিল না। অনেকক্ষণ যাবৎ সে একটা কথা বলি বলি করে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। দুজনকে চুপ থাকতে দেখে সে বলে ফেলল, ‘আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়। বিকেলে একুশে বইমেলায় একটা সেমিনার আছে, চল আমরা সেখানে যাই।’ নির্ঝর এবারও মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল। সে বলল, আমরা কেন একুশে বইমেলায় যাব? তার চেয়ে বরং...।

নির্ঝর তার কথা শেষ করতে পারল না। তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রানা অনেকটা ক্রোধের সুরে বলে, ‘তোমার সব কথাতেই অসম্মতি। এটা করে কি লাভ? ওটা কেনো...?’ রানার কথা শেষ না হতেই তন্ময় তাকে থামিয়ে দেয়। বলে, ‘দেখ এখানে নির্ঝরেরও মতামত ব্যক্ত করার অধিকার আছে। তোমার সঙ্গে মতানৈক্য হতে পারে, কিন্তু তাকে কথা বলতে দেওয়া উচিত।’

তন্ময়ের কথায় রানা বিব্রতবোধ করে। একটু দম নিয়ে নির্ঝর বলে, ১০টায় স্কুলে যে আলোচনা সভা আছে, সেখানেই আমাদের যাওয়া উচিত। নির্ঝরের কথায় রানা একটু লজ্জিত হয়। দুঃখ প্রকাশ করে সে বলে, হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো। একুশে বইমেলার পরিবর্তে স্কুলের অনুষ্ঠানে যাওয়াটাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। কথার সূত্র ধরে তন্ময় বলল, আসলে নিজের প্রতিষ্ঠানকে নিজের দেশকে ভালোবাসাই হলো একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম শিক্ষা।

নির্ঝর আবার বলতে শুরু করে, আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? চলো না আলোচনা শেষে মসজিদে কজন মিলে আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ আমরা শহীদদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করি। নির্ঝরের কথায় সবাই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। পারস্পরিক আলোচনা শেষে তারা আরো স্থির করে বিকেলটা কাটাবে একুশে বইমেলায়। পছন্দমতো কিছু বইও কিনবে তারা।

সন্ধ্যার পর আমরা কী করব? আচ্ছা এ কাজ করলে কেমন হয়? সম্ভবত রানার মনে কিছু একটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই তন্ময় বলে ওঠে, নারে, সন্ধ্যার পর আমার পক্ষে ঘরের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। আম্মু একদম পছন্দ করেন না। তন্ময়ের কথায় নির্ঝর বলে, এত বড় হইছো তারপরও...!! তন্ময় এ ব্যাপারে কিছুই বলে না। এদিকে রানা কিছুটা সংশয় প্রকাশ করে বলল, অন্যরা কত কিছুই করবে। চলো না তাদের জিজ্ঞেস করি। তারা কে কী করবে? বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি। কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই তন্ময় বলে, দেখ তোমরা যা কিছুই করো। আমি যেটা ভেবেছি, সেটাই করবো। তন্ময়ের কথার প্রতিধ্বনি করে নির্ঝর বলল, আমিও তন্ময়ের সঙ্গে একমত।

দেখ, রানা একুশে ফেব্রুয়ারি সফল হয়েছিল আত্মবিশ্বাসের কারণেই। আমার বিশ্বাস, আমাদের পরিকল্পনা অন্যদের চাইতে কোনো অংশেই খারাপ হবে না। চল আজকের এই পড়ন্ত বেলায় আমরা সেই আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার শপথ নেই। ততক্ষণে পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। আলোচনাও তাদের প্রায় শেষ। আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার শপথ নিয়ে এবার তাদের ঘরে ফেরার পালা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close