আব্দুস সালাম

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯

লোভী বাঘের পরিণতি

অনেকদিন আগের কথা। এক দেশে ছিল বড় একটা নদী। সেই নদীর মাঝে ছিল একটা দ্বীপ। আর নদীর পাশে ছিল ছোট্ট একটা বন। বন থেকে দ্বীপটা সুস্পষ্টভাবে দেখা যেত। কিন্তু সেই দ্বীপে কোনো পশুপাখি বাস করত না। বনে যেমন নানা জাতের পশুপাখি বাস করত ঠিক তেমনি নদীতেও অনেক জলজপ্রাণী বসবাস করত। পশুপাখি ও জলজপ্রাণীগুলো যার যার স্থানে সুখে-শান্তিতে বাস করত। বনের পশু আর জলজপ্রাণীদের মধ্যে সখ্য ছিল প্রগাঢ়। কেউ কারোর ক্ষতি করত না। বিপদ-আপদে তারা একে অপরকে সাহায্য করত। তবে বনে নানা জাতের পশুপাখি ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো বাঘ ছিল না। এক দিন হঠাৎ সেই বনে একটা বাঘকে দেখা গেল। বাঘের আবির্ভাবের খবরটি দ্রুত সারা বনে ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পশুপাখিদেরও ঘুম হারাম হয়ে গেল। কারণ বাঘ হলো মাংসাশী প্রাণী। অন্য পশুপাখিদের মাংস খেয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হয়। আর বাঘটি ছিল ভীষণ লোভী ও অত্যাচারী। কারণ-অকারণে বাঘটি একের পর এক প্রাণীদের শিকার করছিল। বনের পাখি ও বাদুড় বাঘের আক্রমণ থেকে কিছুটা রেহাই পেলেও পশুরা ছিল নিরুপায়। ফলে পশুদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য পশুরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করল। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, যদি কুমিরের সাহায্য পাওয়া যায়, তা হলে বন ছেড়ে তারা কিছুদিনের জন্য দ্বীপে আশ্রয় নেবে। তারপর সুযোগ বুঝে আবার বনে ফিরে আসবে। বিষয়টি নিয়ে তারা কুমিরের সঙ্গে আলোচনা করল। কুমির সব কথা শুনে বলল, ‘তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি তোমাদের সবাইকে একে একে দ্বীপে পৌঁছিয়ে দেব। দ্বীপটি হবে তোমাদের জন্য অভয়ারণ্য। আজ রাতেই তোমরা প্রস্তুত থাকবে। তোমাদের সবাইকে পার করে দেব।’

রাতের বেলা সত্যিই সত্যিই কুমিরটা বানর, হরিণ, ভাল্লুক, ঘোড়া, জেব্রা, খরগোশ, শিয়াল, গাধা, শূকর, উল্লুকসহ সব পশুকে পিঠে করে একে একে দ্বীপটিতে পৌঁছে দিল। সেই দ্বীপে পশুদের খাবারের কোনো অভাব ছিল না। তারা আরামে সেখানে দিনাতিপাত করতে থাকল। কদিন পর বাঘটি লক্ষ করল যে, বনে কোনো পশুর অস্তিত্ব নেই। এর ফলে কোনো পশুকে শিকার করতে না পেরে বাঘটি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এক দিন ক্লান্ত হয়ে বাঘটি একটা গাছের নিচে বিশ্রাম করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। একটানা ঘুমে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। বাদুড় নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। একটা বাদুড় উড়তে উড়তে বাঘের নাকের ডগায় এসে ডাকাডাকি শুরু করল। সেই বাদুড়ের ডাকে বাঘের ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণ তারা কথাবার্তা বলল। এতে দুজনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। একপর্যায়ে বাঘটি তার দুঃখের সব কথা জানাল। বনের পশুগুলো কোথায় গেছে, তা বাদুড়ের কাছে জানতে চাইল। বাদুড় বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। এই বনে একটিও পশু নেই। এক দিন রাতে আমি দেখেছি নদীর কুমিরকে বনের সব পশুকে ওই দ্বীপে পৌঁছে দিতে।’ সব ঘটনা জানার পর বাঘটি মনে মনে ভাবল, একবার যদি যেতে পারি, তাহলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না! সব পশুকে একে একে মজা করে খাওয়া যাবে। এর জন্য আমাকেও কুমিরের সাহায্য নিতে হবে। কারণ আমি সাঁতার জানি না। তাছাড়া নদীটিও খর¯্রােতা। সবকিছু চিন্তা করে সে মনে মনে একটু ভয়ও পেল। কুমির যদি সাহায্য না করে! তখন কী হবে? ‘যাই দেখি কিছু করা যায় কি না।’ এই বলে বাঘটি হাঁটা দিল।

পরদিন সকালে বাঘটি কুমিরের সঙ্গে দেখা করার জন্য নদীর তীরে বসে থাকল। এমন সময় সে লক্ষ করল একটু দূরে কুমিরের দুটি বাচ্চা খেলা করছে। তখন ক্ষুধায় বাঘের পেটটা চোঁ চোঁ করছিল। কোনো উপায় না পেয়ে সে কুমিরের একটি বাচ্চা ধরে খেয়ে ফেলল। অপর বাচ্চাটি ভয়ে পানির মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। বাচ্চাটি দ্রুত মায়ের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল। মা কুমির তীরে এসে দেখল বাঘটি সেখানে আর নেই। বাচ্চা খেয়ে পালিয়েছে। কুমির বুঝতে পারল যে, বাঘটি নিশ্চয় দ্বীপে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে। তখন এর প্রতিশোধ নেবই। তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কুমিরটি সুযোগ খুঁজতে থাকে। দুই দিন পর যথারীতি বাঘটি আবার নদীর তীরে এসে কুমিরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কুমির বাঘটিকে দেখে তার নিকটে এসে উপস্থিত হয়। বাঘটিও কুমিরকে দেখে খুশি হলো। কুমির বাঘকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কী হে বাঘ, একা একা কী করছ? মন খারাপ বুঝি?’ উত্তরে বাঘ বলল, ‘কুমির ভাই, আমি ওই দ্বীপে একটু যেতে চাই। আমি তো সাঁতার জানি না। আমাকে একটু সাহায্য করবে?’ ‘কেন করব না? কতজনকেই তো পৌঁছে দিলাম। তোমাকে দেব না কেন? আমার পিঠে এসে বসো। এক্ষুনি পৌঁছে দিচ্ছি।’ এ কথা শুনে বাঘটি ভীষণ খুশি হলো। সে আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ কুমিরের পিঠে উঠে বসে পড়ল। কুমির এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করল না। সেও বাঘকে পিঠে নিয়ে সাঁতার দিল।

কুমির যখন মাঝ নদীতে এসে পৌঁছাল, তখন সে বাঘকে জিজ্ঞাসা করল, দুই দিন ধরে আমার বাচ্চাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি বলতে পার আমার বাচ্চাটি কোথায় আছে?

Ñ কী বল এসব? আমি কী করে বলব? আমার কি সাধ্য আছে পানির নিচে যাওয়া? তাছাড়া সাঁতারও কাটতে পারি না। তাহলে বল তোমার বাচ্চার খোঁজ কীভাবে দেব?

Ñ দুই দিন আগে আমার দুটো বাচ্চা তীরে বসে খেলছিল। আর তুমি একটু দূরেই ছিলে। তাই বলছিলাম...।

বাঘটি বুঝতে পারে সে বিপদে পড়েছে। সে বাঁচার একটা পথ খুঁজতে থাকে। সে কুমিরকে বলল, ‘এক কাজ কর। তুমি আমাকে তীরে নামিয়ে দাও। আমি বনের মধ্যে একটু খুঁজে আসি তোমার বাচ্চাকে পাই কি না দেখি। উত্তরে কুমির বলল, ‘কোথায় আর খুঁজবে? সে তো তোমার পেটেই গেছে। আমার অন্য বাচ্চাটি সব ঘটনা আমাকে বলেছে। তুমি কতটা নির্দয় ও লোভী! আমার বাচ্চা খেয়ে আবার আমার কাছেই এসেছ সাহায্য চাইতে? তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।’ বাঘটি তার কৃতকর্মের জন্য বারবার কুমিরের কাছে ক্ষমা চাইল। কুমির কিছুতেই ক্ষমা করল না। ঠিক নদীর মাঝ বরাবর এসে খর¯্রােতের মধ্যে কুমিরটি ধীরে ধীরে পানির নিচে নেমে গেল। আর বাঘটি হাবুডুবু খেতে খেতে দূরে ভেসে চলে গেল। কিছু দূর যাওয়ার পরই তার করুণ মৃত্যু হলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close