নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৭

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী

ইতিহাস বদলানো যায় না

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দীর্ঘদিন দেশে নিষিদ্ধ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পঁচাত্তরের পর যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল, যারা এ দেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেনি, পাকিস্তানের সেই প্রেতাত্মারাই বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণকে বদলাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইতিহাস বদলানো যায় না। সেটাই আজ প্রমাণিত।’ গতকাল শনিবার বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি পাওয়ায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক কমিটির সমাবেশে এ কথা বলেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় ইউনেসকোকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ নাগরিক সমাবেশে বক্তব্য দেন শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল হক, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বাংলাদেশে ইউনেসকোর আবাসিক প্রতিনিধি বিয়েট্রিস খলদুন।

জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। এরপর ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ শেষে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সেই দিনটি নিয়ে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। রামেন্দু মজুমদার ও নুজহাত চৌধুরীর সঞ্চলনায় বক্তব্যের মাঝে মাঝে গানে গানে আবর্তিত হয় অনুষ্ঠান। গান গেয়ে শোনান শাহীন সামাদ, মমতাজ ও সাজেদ আকবর। আবৃত্তি করেন আসাদুজ্জামান নূর।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যতই বদলে ফেলার চেষ্টা করুক, ইতিহাস তার জায়গা করে নেবে। আজ ইউনেসকোর স্বীকৃতির মাধ্যমে সেটাই প্রমাণ হয়েছে। আজ যখন ইউনেসকো এ ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তখন কি তাদের লজ্জা হয় না? এ দেশের মানুষ ২৩ বছর স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে পারেনি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটা জানতে পারেনি-এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হয় না।

৭ মার্চের ভাষণের কথা হলে প্রথমে মায়ের কথা মনে পড়ে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৭ মার্চে ভাষণ দেওয়ার আগে মা বাবাকে শোওয়ার ঘরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, তুমি ১৫ মিনিট রেস্ট নাও। তখন অনেকের কাছ থেকে অনেক রকম পরামর্শ আসছিল। মা যখন তাকে ঘরে নিয়ে যান, তখন তার পাশে আমি ছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এ দেশের জনগণের জন্য তুমি সারাজীবন সংগ্রাম করেছ, আন্দোলন করেছ। অনেকে অনেক কথা বলবে, কিন্তু তুমি ভাষণে সেই কথাই বলবে, যেটা তোমার মনে আসবে। তুমি ভালো জানো-কী বলতে হবে। এ দেশের মানুষের ভাগ্য তোমার হাতে।’ তিনি বলেন, ‘মা রাজনীতি করেননি, কিন্তু তার রাজনৈতিক চেতনা ছিল প্রবল। তিনি এ সবই শিখেছেন আমার বাবার কাছে। তিনি রাজনীতি বিষয়ে যখন যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটার থেকে ভালো পরামর্শ আর হয়নি।’

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এর আগে স্বীকৃতি পাওয়া ভাষণগুলোর সবই ছিল লিখিত, এই ভাষণ লিখিত ছিল না। ভাষণের সময় হাতে লেখা কোনো নোট নেই, কিচ্ছু নেই। জাতির পিতা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেটা মানুষ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছিল।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘যারা সারাজীবন বাঙালিকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল, তারা পরাজিত শক্তি। আর আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি। জাতির পিতা এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনেতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের যা কিছু আছে তা আমরা রক্ষা করে যাব। জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ইনশাল্লাহ আমরা বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হব। মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থেকেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে-এই নাগরিক সমাজে এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর নিগৃহীত নিপীড়িত জাতির অধিকার আদায়ের অনুপ্রেরণা ও শক্তি জোগাবে। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে অসাধারণ সম্মানিত করেছে। এ ভাষণ এখন পৃথিবীর সম্পদে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিতে হবে। শোষিত জাতি এ ভাষা থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের একান্ত সম্পদ। তবে তিনি সমগ্র বিশ্বেরও।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ যুগে যুগে সারা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ নাগরিক সমাবেশ এটি। ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে ৭ মার্চে সাত কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর একটি আঙুলের নির্দেশে স্থির হয়েছিলেন। তার ভাষণে অন্ধকার ফুঁড়ে জেগে উঠেছিল আলোর ফোয়ারা।’ ইউনেসকো ভাষণকে স্বীকৃতি দেওয়ায় সংস্থাটির মহাপরিচালকের প্রতি ধন্যবাদ প্রস্তাব পড়ে শোনান ওবায়দুল কাদের। এতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইতিহাসের এক অনন্য মুক্তির বাণী। এর মধ্য দিয়ে একটি জাতি একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।

সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে কোনো তৎসম শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি সহজ সরল বাংলা ব্যবহার করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নময়ী। তিনি স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন। স্বপ্ন দেখাতেও ভালোবাসেন। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন, আমি সব হারিয়েছি। তবে আমরা আপনাকে হারাতে চাই না। আমি গ্রামে গিয়েছি। সব বদলে গেছে। সেখানে দারিদ্র্য নেই। হলফ করে বলতে পারি, অনেক উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু সরকারের উন্নয়ন প্রচার কম হচ্ছে। সরকারের এসব উন্নয়ন প্রচার করতে হবে।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ফলই হচ্ছে ৭ মার্চের বক্তব্য। যে বক্তব্য শুনে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শুধু ১০ লাখ মানুষ নয়, সারা বাংলার মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত হয়েছিল। জয় বাংলা স্লোগানেই শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি বিষয় বিশদভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরতে শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ জানান এ শিক্ষাবিদ।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেসকো জাতির জনককে সম্মানিত করেছে। আমি বলব, ঐতিহাসিক এ ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করে বরং ইউনেসকো সম্মানিত হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পূরণ করতে হবে এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘লেখককে তার লেখা দিয়ে, শিল্পীকে তার কণ্ঠ দিয়ে শত্রু মোকাবিলা করতে হবে।’

সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ‘বিশ্ব ঐহিত্যের প্রামাণ্য দলিল’ হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউনেসকোর আবাসিক প্রতিনিধি বিয়েট্রিস খলদুন। তিনি বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ যুক্ত করে নিয়েছে ইউনেসকো। এ জন্য ইউনেসকোও গর্বিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ঐতিহাসিক নথি ও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ভাষণটির ওপর অনেক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। একটি ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতিকে একত্রিত করার ইতিহাসের দলিল এটি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist