হাসান ইমন
ঈদ যাত্রায় এবারও দুর্ভোগের শঙ্কা
বৃষ্টি-বন্যায় বেহাল সড়ক মহাসড়ক
পবিত্র ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র আট দিন। আগামী বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের মূল স্রোত নামবে পথে। লঞ্চ ও ট্রেনের পাশাপাশি সড়কপথে বাসেও চাপবে এসব মানুষ। কিন্তু অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কপথে দুর্ভোগে পড়তে হবে যাত্রীদের। কারণ ইতোমধ্যেই কার্পেটিং, ইট, বালু ও খোয়া উঠে দেশের অধিকাংশ সড়ক ও মহাসড়ক খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। এমনকি সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা বিবেচনা করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও নির্বিঘ্নে ঈদযাত্রায় দুর্ভোগের আশঙ্কা করছেন।
এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, এবার অতিবর্ষণ ও উজান থেকে আসা পানির স্রোত এত তীব্র যে, সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কের ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ১-৩ কিমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। উত্তরাঞ্চলসহ বেশ কিছু জেলার সড়কগুলোর ১৮টি পয়েন্ট পানির তোড়ে ভেসে গেছে। এসব রাস্তা কিছুতেই ঈদের আগে মেরামত করা সম্ভব নয়। তবে ঈদের আগে বৃষ্টি না হলে রাস্তাগুলো চলাচলের কিছুটা উপযোগী করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী। তিনি জানান, ঈদযাত্রায় সবাই যাতে নির্বিঘেœ যাতায়াত করতে পারে সে জন্য প্রকৌশলীরা দিন-রাত কাজ করছেন।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এখনো কোনো কোনো মহাসড়কের খানাখন্দে পানি জমে আছে। দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক যান চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন স্থানে সড়কের কারণে গণপরিবহনে দুর্ভোগের খবর আসছে। বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থা সবচেয়ে বেহাল। এসব পথে ভোগান্তি প্রকট হচ্ছে। ফলে এবার সড়কপথে দুর্ভোগের শঙ্কা রয়েছে। এবার ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা করছেন পরিবহন মালিকরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, উত্তরবঙ্গের রাস্তা এতটাই খারাপ যে বাস আজ ঢাকা ছাড়লে কাল ফিরে আসে। যেমনÑময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসতে আগে সময় লাগত তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। আর এখন লাগছে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। এবার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতেই হবে।
সওজ অধিদফতরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে দেশের ৩৯ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভালো অবস্থায় রয়েছে। ৩৭ শতাংশ ভাঙাচোরা। অবশিষ্ট ২৪ শতাংশ সড়ক মোটামুটি চলনসই। এগুলোর কিছু অংশে হালকা বা ভারী মেরামত প্রয়োজন। বাকি সড়ক পুনর্নির্মাণ করতে হবে।
সড়কগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সওজ অধিদফতর জানায়, সওজের আওতাধীন সড়কের মধ্যে ভালো অবস্থায় আছে ছয় হাজার ৫০৯ কিলোমিটার। বাকি অংশের মধ্যে তিন হাজার ৯০৫ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক মোটামুটি চলনসই। আর ছয় হাজার ২০৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। এর মধ্যে জেলা সড়কগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তবে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের অবস্থা তুলনামূলক কম খারাপ। একইভাবে তিন হাজার ৬৫৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে এক হাজার ৯৭৭ কিলোমিটার বা ৫৪ শতাংশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। মোটামুটি চলনসই অবস্থায় আছে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক। বাকি ২০ দশমিক ৪৪ শতাংশে খানাখন্দ রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বৃষ্টি ও বন্যায় সড়ক-মহাসড়কের কতটা পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো নিরূপণ করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ অধিদফতর। সংস্থাটির মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম) জানিয়েছেন, পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে।
এই বিষয়ে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি অব্যাহত আছে। এর সঙ্গে কিছু জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে ভাঙাচোরার সঙ্গে ভালো সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সড়ক-মহাসড়ক ঠিক রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলীরা। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়নি। কিছু এলাকায় এখনো সড়কে পানি রয়েছে। বৃষ্টি ও বন্যা চলে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। তখন সরকারের কাছে স্থায়ী সড়ক মেরামতের জন্য অর্থ চাওয়া হবে। তবে বড় ধরনের দুর্ভোগ কমাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোয় অস্থায়ী ভিত্তিতে ইট-বালু দিয়ে সংস্কার হচ্ছে। যাতে ঈদে ঘুরমুখো মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা লাগব হয়।
সড়কগুলোর অবস্থা বর্ণনা করে বাসচালকরা জানান, গত কয়েক দিনে বৃষ্টি ও বন্যার কারণে দেশের অনেক এলাকায় সড়ক-মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোথাও কোথাও মহাসড়ক তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার শেরপুর পর্যন্ত মহাসড়কটি এখনো চলাচলের উপযোগী করে মেরামতের কাজ সম্পন্ন হয়নি। দেখা গেছে, বিটুমিন নয়, ইট ফেলে গর্ত ভরাট করা হয়েছে। গাড়ি চলাচলে ইট উঠে আবার গর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। চান্দাইগোন ও রায়গঞ্জে মহাসড়কের অবস্থা আগে থেকেই বেহাল। হাটিকুমরুল থেকে উল্লাপাড়া পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় লাগছে।
চালকরা আরো জানান, ঢাকা থেকে গাজীপুরের রাস্তাটিরও বেহাল দশা। ঢাকা-দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়কে কমপক্ষে ৬৮ কিলোমিটারজুড়ে খানাখন্দ। ঢাকা-চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকা ও ফেনী-নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কটিও চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে গোড়াই পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সর্বত্র সড়কের পিচ উঠে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এই মহাসড়কটিতে কয়েক দিন ধরে যানজটের সৃষ্টি হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও যানজট লেগেই আছে। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জেলা মহাসড়কগুলো সংস্কার না করায় খানাখন্দ ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে আছে। কোনো যানবাহনই ওই সব সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
একইভাবে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের অবস্থাও ভালো নয়। দৌলতদিয়া ঘাট থেকে রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তপুর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এবং রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের ৪৯ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খারাপ। দৌলতদিয়া থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত বেহাল সড়কের কারণে শুধু খুলনা বিভাগের ১০ জেলার যাত্রীদের ভুগতে হবে ঈদযাত্রায়। ঢাকা বরিশাল মহাসড়কের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা বেহালদশায় রয়েছে। বিশেষ করে জয়শ্রী থেকে ভুরঘাটা পর্যন্ত রাস্তা খানাখন্দে ভরপুর। প্রায়ই এ সড়কে বাস-ট্রাক ফেঁসে (আটকা পড়ে) যায়; রেকার দিয়ে ওঠাতে হয়। আর ছোট গাড়ি তো চলতেই পারছে না।
বরিশাল জেলা বাসমালিক সমিতির সভাপতি মো. আফতাব হোসেন জানান, পবিত্র ঈদুল আজহা সন্নিকটে এসে গেছে। ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে মানুষ এই মহাসড়ক হয়ে বরিশালে আসবে, আবার বরিশাল থেকে ঢাকায় যাবে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে সড়ক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির প্রধান কারণ যানজট। রাজধানী থেকে শুরু হয়ে এ যানজট প্রকট থাকে জাতীয় মহাসড়কগুলোয়ও। অতীতে ঈদের আগেই দূরপাল্লার বাসের সব ট্রিপের আগাম টিকিট বিক্রি করা হতো। এবার দুর্ভোগের ভয়ে পরিবহন কোম্পানিগুলোর অন্তত এক-তৃতীয়াংশ টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে না। মহাখালী বাস টার্মিনালের অরিন পরিবহনের মো. রানা জানান, তাদের ২০টি বাসের মধ্যে ১৫টির আগাম টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে, বাকি ৫টি জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। পথে কোনো গাড়ি আটকে গেলে, এসব বাসের মাধ্যমে আগাম টিকিট কেনা যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে।
"