নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৯ এপ্রিল, ২০২৪

কেনাকাটা বেড়েছে বিত্তশালীদের, কমছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের

এবার ঈদে অভিজাত শপিংমলগুলোয় লাইন ধরে ক্রেতারা প্রবেশ করছেন। পছন্দের পোশাকও কিনছেন তারা। এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মার্কেটে। ক্রেতা তুলনামূলক কম। মার্কেটে এলেও দাম শুনে পছন্দের পোশাক কিনতে পারছেন না। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন দোকান ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। ঈদের সময় পাঞ্জাবির দোকানে তুলনামূলক বেশি বেচাকেনা হয়। সম্প্রতি পাঞ্জাবির বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইল্লিয়্যিন।

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের ইল্লিয়্যিনের শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ক্রেতাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বিক্রয় প্রতিনিধিরা। আউটলেটটির বাইরে ক্রেতারা সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছেন। ভেতর থেকে কেউ বের হলে ঢুকছেন অন্য ক্রেতা। এ ব্র্যান্ডের পণ্যের মূল্যও আকাশছোঁয়া। কথা হয় সে শোরুমের এক জ্যেষ্ঠ বিক্রয় সহকারীর সঙ্গে। ব্যবস্থাপনা পর্ষদের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বেচাবিক্রি সম্পর্কে সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। তবে নাম প্রকাশ হবে না নিশ্চিত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে পাঞ্জাবির চাহিদা বেড়েছে। অনেক ক্রেতাকে আমরা ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। অধিকাংশ পাঞ্জাবির সাইজ শেষ। অবশিষ্ট একটি-দুটি সাইজে মিললে পাঞ্জাবি পাচ্ছেন ক্রেতারা। এরপরও দৈনিক চারশর বেশি পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে এ আউটলেট থেকে। এসব পাঞ্জাবির দাম ৩ হাজার ৬৫০ থেকে শুরু হয়ে ৯ হাজার ২৫০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।’

বসুন্ধরা শপিংমলে অবস্থিত পাঞ্জাবির আরেকটি শোরুম লুবনান। প্রতিষ্ঠানটির শোরুম ইনচার্জ রিয়াজ হোসেন রাজু জানান, তারা দৈনিক ২৫০-৩০০টির বেশি পাঞ্জাবি বিক্রি করছেন। দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে শুরু হয়ে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে অনেক সময় গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সাইজ দিতে পারেন না তারা। রিয়াজ হোসেন রাজুর ভাষ্য, লুবনানের প্রতিটি শোরুম একটি ডিজাইনের ১২টি করে পাঞ্জাবি পায়। অনেক সময় নির্দিষ্ট ডিজাইনের পাঞ্জাবি সাইজ অনুযায়ী সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনে সীমাদ্ধতা রয়েছে। দেখা গেল, প্রদর্শনী থেকে গ্রাহক পাঞ্জাবি পছন্দ করে সাইজ মিলিয়ে দিতে বলছেন, স্টোরে গিয়ে দেখা যায় ওই সাইজ বিক্রি হয়ে গেছে। ইল্লিয়্যিন থেকে পাঞ্জাবি কিনে বেরিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম। হাতে বেশ কয়েকটি ব্যাগ দেখে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন চারটি পাঞ্জাবি কিনেছেন তিনি। কামরুল হাসান বলেন, ‘ঈদে যা কিছুই হোক সবারই নতুন পাঞ্জাবি লাগে।’ দাম বেশি হলেও পরিবারের লোকদের খুশি করতে ইল্লিয়্যিন থেকে পাঞ্জাবি কিনেছেন তিনি।

একই শপিংমলের আরেকটি শোরুম দেশি দশ। স্বনামধন্য ১০টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, অঞ্জনস, রঙ বাংলাদেশ, বাংলার মেলা, সাদাকালো, বিবিয়ানা, দেশাল, নগরদোলা ও সৃষ্টির সমন্বয়ে একই ছাদের নিচে ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন ব্যবস্থাপক মো. শরীফুজ্জামান জানান, রমজানের শুরু থেকে ভালো ব্যবসা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এপ্রিলের শুরু থেকে ব্যবসা কমে এসেছে। এ সময়ে বেচাকেনা আগের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে বলে দাবি করছেন তিনি। এখানে পোশাক কিনতে আসা ইসরাত জাহান নামে এক তরুণী বলেন, ‘নতুন পোশাক ছাড়া ঈদ কল্পনাই করা যায় না। আবার ঈদের পর পারিবারিক অনুষ্ঠান আছে। সেজন্য একাই তিনটি জামা নিয়েছি।’

তুলনামূলক বিপরীত চিত্র পাওয়া গেল নিউমার্কেটে। সাধারণত মধ্যবিত্তরা এখানে কেনাকাটা করতে আসেন। মার্কেটটিতে মানুষের ভিড় থাকলেও বিকিকিনি সে অনুযায়ী হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ক্রেতারা মার্কেটে আসেন ঠিকই। জামাকাপড়ও হাতে নিয়ে দেখেন। তবে অধিকাংশ না কিনে চলে যান। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী সোহেল মিয়া বলেন, ‘এ বছর আশানুরূপ বিক্রি করতে পারিনি। ক্রেতারা পোশাক কিনতে এসে দরদাম করে চলে যাচ্ছেন। দিনে ২০-২৫টির বেশি পাঞ্জাবি বিক্রি করতে পারছি না।’

গুলিস্তানের ফুটপাতে শার্ট-প্যান্ট নিয়ে বসেন মো. রুবেল হোসেন। ঈদ উপলক্ষে পাঞ্জাবির সংগ্রহ বাড়িয়েছেন তিনি। তবে প্রথম লটে সংগৃহীত পাঞ্জাবিই বিক্রি করে শেষ করতে পারেননি। দৈনিক সর্বোচ্চ সাত-আটটি পোশাক বিক্রি করতে পারছেন তিনি। কোনো কোনোদিন দু-তিনটিতেই থেমে থাকে এ সংখ্যা। রুবেল বলেন, ‘ফুটপাতে মানুষের আনাগোনা হয়, ভিড় হয়। তবে মানুষ জামাকাপড় কিনছেন না। ১০ জন মানুষ দেখে একজন কিনছেন। বাকিরা দাম জিজ্ঞেস করেই চলে যাচ্ছেন।’

একই চিত্র নিউমার্কেটের ফুটপাতেও। নিম্নবিত্ত মানুষের শেষ ভরসা ফুটপাতের দোকানে তুলনামূলকভাবে দাম কম হওয়ায় এখান থেকে পছন্দের পোশাক কেনেন স্বল্প আয়ধারীরা। তবে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে তাদের সে স্বপ্নও ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। নিউমার্কেটের প্রধান ফটকের পাশের ফুটপাতের একটি দোকানে কন্যাসন্তানের জন্য জামা নেড়েচেড়ে দেখছিলেন দিনমজুর হাকিম সবুর। অনেকক্ষণ দেখার পর একটি জামা পছন্দ করেছেন তিনি। তবে দোকানিকে দাম জিজ্ঞেস করতেই চেহারা মলিন হয়ে আসে তার। পকেটে হাত দিয়ে টাকার হিসাব করে দাম মেটাতে পারেননি। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে পোশাকটি রেখে দেন তিনি। জিজ্ঞেস করলে হাকিম সবুর বলেন, ‘ছোট ছেলেটার জন্য একটা শার্ট কিনেছি। প্যান্ট কেনার টাকা নেই। মেয়েটা একটা ফ্রকের আবদার করছিল। কাল আরো কিছু টাকা জমিয়ে এসে নেব।’

ফুটপাতের আরেক দোকানি কালাম মিয়া বলেন, ‘মানুষ এখন আগের মতো কেনাকাটা করতে পারছে না। আমাদেরও বেচাবিক্রি কম। ঈদের বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। তবে এবার খুব একটা লাভ করতে পারছি না।’ আজিমপুরের এক মুদি ব্যবসায়ী মকবুল রহমান ফুটপাত থেকেই পরিবারের জন্য পোশাক কিনছিলেন। তিনি বলেন, ‘মার্কেটে জামা-কাপড়ের অনেক দাম। ফুটপাতই এখন শেষ ভরসা। দুই মেয়ে আর এক ছেলের জন্য ফুটপাত থেকে পোশাক কিনে আগামীকাল বাড়ি যাব। স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ি কিনব ভেবেছিলাম। সন্তানদের জন্য কিনতেই জোগাড় করা টাকা শেষ। নিজের জন্য কিছু কিনিনি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close