নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ মে, ২০২৪

ট্রাকচালক থেকে কোটিপতি নূর

রাজধানীর তুরাগ এলাকার অক্ষরজ্ঞানহীন ট্রাকচালক নূর হোসেন (৫৫) যেন পেয়েছেন আলাদীনের চেরাগ। মাত্র কয়েক বছর আগে দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এরপর ট্রাকচালক হিসেবে নামেন রাস্তায়। বেতনে সংসার চলত না বলে দাবি করতেন। সেই নূর হোসেন যেন হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। রাতারাতি হয়ে যান শতকোটি টাকার মালিক। বর্তমানে তিনি রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতে চান। হতে চান ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে সুবিধাও নেন বিস্তর। দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ট্রাকচালক থেকে শতকোটি টাকার মালিক হওয়া নূরের ফিরিস্তি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হঠাৎ করে ক্ষমতাসীন দলের উত্তরার এক প্রভাবশালী নেতার সান্নিধ্যে এসে নূরের চেহারা পাল্টে যায়। আলাদীনের চেরাগের কেরামতির মতোই রাতারাতি বনে যান কোটিপতি। অভিযোগ রয়েছে, তুরাগের দিয়াবাড়ী-নয়ানগর এলাকায় নূরের নেতৃত্বে অপরাধজগতে জড়িয়ে পড়েছে শতাধিক কিশোর। এসব কিশোরকে পেশিশক্তির প্রদর্শনে ব্যবহার করেন নূর হোসেন। এছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত তারা। পুলিশের কাছে ধরা পড়লে ছাড়িয়েও আনেন নূর। এছাড়া নূরের বিরুদ্ধে জাল দলিল তৈরির মাধ্যমে অন্যের জমি দখল, মামলা-বাণিজ্য, শতাধিক দোকান থেকে চাঁদা আদায়সহ একাধিক খুনির আশ্রয়দাতা হিসেবে শক্ত অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তুরাগ এলাকায় উত্তরার তৃতীয় প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণকালে জমির দালালি শুরু করেন নূর। কোনো জমি কিনতে বা বিক্রি করতে হলে শরণাপন্ন হতে হয় নূরের। কেউ তার দরবারে না গেলে শেষ রক্ষা হয় না। কথা না শুনলে দিতেন হুমকি। জমি বিক্রির সময় দুই পক্ষ থেকে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। ট্রাকচালক থেকে তুরাগ চরে বালুশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন নূর। অল্পসময়ে হয়ে ওঠেন তুরাগের বালুখেকো। তুরাগ নদী থেকে বালু তুলে বিক্রির ব্যবসা শুরুর পর পরিচয় হয় সরকারি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সঙ্গে। রাজনীতির সংস্পর্শে এসে নূর হোসেন কয়েক বছরেই বনে যান শতকোটি টাকার মালিক। পদপদবি না থাকলেও তার ভয়ে কাঁপে দলের অন্য নেতারা।

ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রভাবশালী নেতা আক্ষেপ করে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘নূর হোসেনের কোনো পদপদবি নেই। তার নেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা। তবু এক প্রভাবশালী নেতার সংস্পর্শে এসে সব সেক্টর থেকে প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন তিনি। বর্তমানে টাকার গরমে সিনিয়র কোনো নেতাকে পাত্তা দেন না নূর হোসেন।’ দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই নূর। তবে পদে না থাকলেও পদপদবি পাইয়ে দেওয়ার তদবির করেন তিনি। অন্যের দলীয় পদ দখল করে সেজেছেন নেতা। সামনে কাউন্সিলর নির্বাচনে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছেন নূর। দলের মধ্যে তাকে নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা বাড়ছে।

জানা যায়, নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে বেপরোয়া নূর হোসেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডকেন্দ্রিক গড়ে তুলেছেন সন্ত্রাসী বাহিনী। সেইসঙ্গে পাড়া-মহল্লায় প্রভাব বিস্তারে গড়েছেন কিশোর গ্যাং। স্থানীয় বাজারে চাঁদাবাজি থেকে চুরি-ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ হয় এসব কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে। সম্প্রতি সরকারি খতিয়ানভুক্ত জমিও বিভিন্ন কোম্পানিকে পাইয়ে দেওয়ার ফন্দিফিকির করে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৫ কোটি টাকা। তার এসব কাজে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা। মূলত তার ‘কাছের লোক’ পরিচয় দিয়েই নূর হোসেন ব্যাপক ক্ষমতাবান সেজেছেন! এছাড়া স্থানীয় কয়েকজনের জমি দখল করে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে।

তথ্য বলছে, তুরাগের নলভোগ মৌজার স্থানীয় রমজান আলী ও মৃত জব্বার আলীর ওয়ারিশদের ৬ বিঘা জমি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে নূর। সিএস রের্কডীয় এসব সম্পতির ভুয়া দলিল করে প্রথমে দখল নেন নূর। পরে একই খতিয়ানের অপর মালিক নূর হোসেনের খালু লাল মিয়া মেম্বারকে নিয়ে একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে জমি থেকে বিতাড়িত করেন। সাবেক এক প্রভাবশালী নেতার নাম ভাঙিয়ে শতকোটি টাকা দামের জমি পানির দামে বিক্রি করে নূর হোসেন। এছাড়া এসব জমি লাগোয়া সরকারি খাসজমিও কোম্পানির দখলে দিয়ে দেয় চক্রটি, যার মূল্য হিসেবে নূর হোসেন গং প্রায় ১০ কোটি হাতিয়ে নেন।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী রমজান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘নূর হোসেন ও তার খালু লাল মিয়া মেম্বার আমার দখলে থাকা বাবার সম্পত্তি প্রথমে জোর করে দখল করেন। পরে শুনি, ভুয়া দলিলের মাধ্যমে একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন। আমার জমিতে বালু ফেলার কারণ জানতে চাইলে নূর হোসেন আমাকে জানান, এ জমি এমপি ক্রয় করেছেন। এখানে আর্মি-পুলিশের আরো বড় বড় অফিসার আছেন। তোমার কোনো জমি নেই। খামোখা এগুলো নিয়ে ঝামেলা করিও না। শেষে লাইফ শেষ হয়ে যাবেগা। আমি নিরীহ মানুষ, তাই আমার জমি রক্ষা করতে পারিনি। বালু ভরাট করে তারা আমার জমিতে বিল্ডিং বানাচ্ছে। আমার জমি ফেরত আনতে আমি কোর্টে মামলা করেছি। এখন নূর হোসেন আমাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমার বাড়ির সামনে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ঘোরাফেরা করছে। নূর হোসেন আমাকে চাপ দিচ্ছে- যাতে মামলা তুলে নিই।’

এ বিষয়ে রমজান আলীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি রমজান আলীর বাবার সম্পত্তি হিসাব-নিকাশ করে দেখি, প্রায় ৮০ শতাংশ জমির মালিক রমজান। এটা তার পৈতৃক সম্পত্তি। এ বিষয়ে মামলা চলছে। একই খতিয়ানে জব্বার আলীর পরিবারের জমিও রয়েছে। শুনেছি, এ পরিবারের জমিও বেদখল হয়েছে। নূর হোসেনের বিষয়ে তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের পদধারী এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, নূর হোসেন তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক বলে পরিচয় দিচ্ছেন। সেই পদটি তার নয়। স্থানীয় চন্ডালভোগ গ্রামের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন মূলত এ পদের আসল ব্যক্তি। কিন্তু প্রভাবশালী এক নেতা ট্রাকচালক নূর হোসেনকে এ পদ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পরই ঘুরে যায় প্রতারক নূর হোসেনের জীবনের চাকা। প্রভাবশালী সেই নেতার ছত্রছয়ায় গত কয়েক বছরে নূর শতকোটি টাকার মালিক বনে যান। আওয়ামী লীগের পরিবর্তে ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে নূর হোসেন লীগ চালু করেন প্রভাবশালী নূর। বেশ কয়েকবার গরু বাজারের ইজারা পাওয়ার পর নূরের পোয়াবারো হয়। সেইসঙ্গে উত্তরা নতুন সেক্টরের দখল চাঁদাবাজির একচ্ছত্র কর্তা হিসেবে পরিচিতি পান নূর।

নূর হোসেনের সম্পদের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় বালুশ্রমিক নূর দিয়াবাড়ী-নয়ানগর এলাকায় (উত্তরা সেক্টর-১৫) তিনটি বাড়ি ও একটি প্লটের মালিক। এর মধ্যে একটি বাড়ি ছয়তলা, একটি পাঁচতলা, আরেকটি সাততলা ভবন। নিজে যে বাড়িতে বাস করেন, সেই বাড়ির ইন্টরিয়র সাজিয়েছেন প্রায় কোটি টাকা খরচ করে। উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে রয়েছে একটি প্লট। এছাড়া আশুলিয়ার কাঠগড়া মৌজায় রয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের এক একর জমি, পূবাইলের মাজুখান এলাকায়ও রয়েছে ১ বিঘা জমি। গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় ২ বিঘা জমির ওপর একটি বাংলোবাড়ি আছে। কক্সবাজারে রয়েছে প্যালেস নামের ৭ তলার একটি বিলাসবহুল হোটেল। এছাড়া উত্তরার দক্ষিণখান এলাকায় একটি বাড়ি সম্প্রতি বিক্রি করেছেন বলে শোনা যায়। বর্তমানে নূর হোসেনের মালিকানায় রয়েছে একটি প্রাডো জিপ ও একটি প্রাইভেট প্রিমিও গাড়ি। তুরাগে ৫ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা আলিশান বাড়িটিও একটি ডেভেলপার কোম্পানি থেকে সুবিধা নিয়ে বানিয়েছেন বলে জানান এলাকাবাসী।

দলীয় পরিচয়ে নূর হোসেনের এত এত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চাইলে তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখন সে টাকার মালিক। আলিশান জীবন। আসলে নষ্ট রাজনীতির ফল হচ্ছে এ নূর হোসেন।’ বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার পরও চাঁদাবাজি ছাড়েননি নূর হোসেন। দিয়াবাড়ী এলাকার লেকপাড়ে ফুচকাসহ অর্ধশতাধিক দোকান বসিয়ে ভাড়া তোলেন তিনি। প্রতিটি দোকান থেকে নূর হোসেন মাসে ভাড়া আদায় করেন ১০ হাজার টাকা করে। ক’দিন আগেও স্থানীয় লাইনম্যান রমজানের মাধ্যমে পুরো নতুন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করেন নূর হোসেন। জানা যায়, দিয়াবাড়ী-নয়ানগর এলাকার অপরাধজগৎ দাপিয়ে বেড়ানো শতাধিক কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী-ছিনতাইকারী, খুনির আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠেন নূর হোসেন। ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রুবেল, এজাজ, সাগর, রিপন, সালাউদ্দিন, স্বাধীন, সালাম, রানা, রনি, বাপ্পী বর্তমানে নূর হোসেনের সার্বক্ষণিক সহযোগী। এছাড়া দখলদারি বজায় রাখতে মিরপুর থেকে সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনেন নূর হোসেন।

নূর হোসেনকে দীর্ঘ এক মাস ধরে মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করার পরও তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১১টায় তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের সংবাদের এ প্রতিনিধির। এ সময় তিনি বাড়ির নিচে ৮-১০ জন উঠতি বয়সের ছেলেকে নিয়ে গল্প করছিলেন। সামনা-সামনি ফোন না ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। অভিযোগ সম্পর্র্কে জানতে চাইলে নূর হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমার সম্পদের বিষয়ে কারো কাছে জবাবদিহি করতে রাজি নই। আমার বিরুদ্ধে নিউজ হলে হবে। কাউকে পরোয়া করি না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close