মেহেদী হাসান

  ৩০ মার্চ, ২০২৪

নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির

রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা। দুই আঁটি লালশাক, এক কেজি বেগুন কিনে গেলেন গরুর মাংসের দোকানে। কারণ ৬ মাসের মধ্যে তিনি গরুর মাংস খেতে পারেননি বলে আক্ষেপ করলেন। কিন্তু দাম সাধ্যের বাইরে যাওয়ায় গরুর মাংস কেনা আর হয়নি। শেষমেষ একটি দেড় কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি কিনেই বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। তবে শুধু গরুর মাংসই নয়; মোটা দাগে দাম বেড়েছে ১০টি পণ্যের। মূূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। ফলে প্রভাব পড়েছে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এবার আটা, চাল, ছোলা, পেঁয়াজ, দেশি রসুন, সয়াবিন তেল (বোতল), চিনি, মসুর ডাল (বড় দানা), অ্যাংকর ডাল, দেশি শুকনা মরিচ, গরুর মাংস, ডিম (হালি), রুই মাছ, ব্রয়লার মুরগি ও খেজুরসহ ১৫টি পণ্যের মধ্যে মাত্র ৫টির দাম কমেছে।

এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। জানুয়ারি মাসে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৮৬। তবে চলতি মাসে এ পর্যন্ত এখনো ৯ শতাংশের ওপরেই রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশ লম্বা সময় ধরে চলছে। এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমন্বিত উদ্যোগের অভাব আছে। গত মাসের যে মূল্যস্ফীতির হিসাব দেওয়া হয়েছে, সেটি মূলত গত বছরের ফেব্রুয়ারির সঙ্গে তুলনা করে। সেই হিসাবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বেড়েছে। এ চাপ সামাল দেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। মূল্যস্ফীতির হার অনুসারে গত বছর যে পণ্য ১০০ টাকায় পাওয়া যেত তা এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গুনতে হয়েছে ১১০ টাকা। অবশ্য মানুষের আয় বেড়েছে ৭.৭৮ শতাংশ যা মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় কম।

উত্তপ্ত চালের বাজার : সারা দেশে লাগাতার অভিযান আর কোটি টাকার বেশি জরিমানা করে লাগাম টানা যায়নি চালের বাজারে। এরপর শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দিয়েও হয়নি কাজ। সর্বশেষ ৩০ প্রতিষ্ঠানকে ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। তবে সেই চাল আনা নিয়ে শুরু হয়েছে টালবাহানা। সরকারের এসব পদক্ষেপকে পাত্তাই দিচ্ছেন না অসাধু চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। গত এক সপ্তাহে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। নতুন করে চালের দাম বাড়ায় বিপদে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতারা।

খুচরা ও পাইকাররা মিলে দোষ দিচ্ছেন মিলারদের। তারা বলছেন, রোজার সময় বাজারে চালের ক্রেতা থাকে কম। তাই দামও স্বাভাবিক থাকার কথা। তবে বাজার কমার কোনো কথা নেই। কোনো কারণ ছাড়াই মিলগেটে বস্তাপ্রতি চালের দর বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।

অন্যদিকে মিলারদের দাবি, ধান সংকট। এজন্য তারা দায়ী করছেন মৌসুমি মজুদদারদের। তাদের ভাষ্য, কৃষকের কাছ থেকে কম দরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ধান কিনে রেখেছেন। ফলে কৃষকের কাছে ধান নেই। মিলারা বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে মজুদদারের কাছ থেকে ধান কিনতে। ধানের দাম বেশি হওয়ায় মিল পর্যায়ে চালের কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকার মতো দর বেড়েছে। বাজারে ব্রি-২৮ ও পাইজাম জাতের চাল সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। ঢাকার মগবাজার, সেগুনবাগিচা, তেজকুনিপাড়া, কারওয়ানবাজারসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাঝারি চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা দরে এবং গুটি স্বর্ণা বা মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়। আট-দশ দিন আগে এ দুই জাতের চালের দর ছিল যথাক্রমে ৫২ থেকে ৫৪ ও ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। একই সময় চিকন বা মিনিকেট চালের কেজি ছিল ৬৮ থেকে ৭২ টাকা, ভোক্তাদের এখন কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকা দরে। সেই হিসাবে এ তিন জাতের চালের কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৪ টাকা।

ক্রেতা রাকিবুল হাসান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ধানের দাম বেশি। চালের দামও বেশি। বাজারে চাল, আটা, ডাল, তেল এমন কোন জিনিস নেই যার দাম কম। মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। মানুষ কিছু বলছে না। যেভাবে দাম বেড়েছে সেভাবে বেতন বাড়েনি।’

সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, ক্রয়ক্ষমতার বাইরে মাংস : রমজানের শুরুতে সবজির দাম চড়া থাকলেও কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে সবজির বাজারে। অন্যদিকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্রয়লার মুরগির কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকা, সোনালি ৬০ টাকা, লেয়ার ৮০ টাকা। বাজারে গরুর মাংসের বিক্রি কমেছে। উল্টোদিকে চাহিদা ও বিক্রি বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির। তবে সবজির দাম কিছুটা কমেছে। আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। গোল বেগুন প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, ফুলকপি ৩০ থেকে ৪০ পিস, একই দামে বিক্রি হচ্ছে বাঁধাকপি। শিম ও টমেটো ৬০ থেকে ৭০ টাকা, শসা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, করলা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং লাউয়ের আকার ও মানভেদে ৩০ থেকে ৫০ টাকায় টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়াও প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে আদা-রসুন। নতুন রসুন ১২০ থেকে ১৬০ টাকা ও আদা ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, আকারভেদে তেলাপিয়া ২২০ থেকে ২৩০ টাকা, পাঙ্গাশ ২০০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহেও ১০ থেকে ২০ টাকা কম দামে বিক্রি হয়েছে। মাঝারি ও বড় আকারের চাষের রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছের দাম প্রতি কেজি ৩০০ থেকে শুরু করে আকার ভেদে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আর ৬০০ টাকার নিচে মিলছে না পাবদা, টেংরা, কই, বোয়াল, চিতল, আইড় ও ইলিশ। মাছের আকার অনুযায়ী দামে কিছুটা কমবেশি দেখা গেছে।

ক্রেতা সারোয়ার জাহান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘পাঙ্গাস মাছ ১৪০ টাকা কেজি কিনেছি। এখন কিনতে হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। তেলাপিয়া মাছের দাম ১৬০ টাকা ছিল সেটি এখন ২২০ টাকা। মানুষ কি খেয়ে বাঁচবে?’

মহাখালী নিকেতন বাজারের গরুর মাংস বিক্রেতা মালেকুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আগে দিনে অন্তত ৫০ হাজার টাকার মাংস বিক্রি করতাম। এখন কমে ১০ থেকে ১২ হাজারে নেমে এসেছে। গরুর মাংস মানুষ কিনছে খুবই কম। মানুষ মুরগির মাংস কিনছে বেশি।’

আরেক বিক্রেতা রবিউল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, গরুর মাংস বিক্রি করছি ৭৫০ টাকা। খলিল গরুর মাংস ৫৯৫ টাকায় কীভাবে বিক্রি করে সেটা বুঝে আসে না। লোকসান হওয়ার কথা তার। পরে ঠিকই ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৯৫ টাকা করেছে। তবে এটা ঠিক যে, মাংস বিক্রি আগের তুলনায় কমেছে। এখন মানুষ মুরগি কিনছে। যাদের একটু ভালো অবস্থা তারা ছাড়া গরু-খাসির মাংস কিনছে না। ১২০০ টাকা কেজি খাসির মাংস একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ কিনছে না।

মুরগি বিক্রেতা সফিউল ইসলাম জানান, প্রতি কেজি ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২১৫ টাকা, সোনালি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। কক মুরগি ৩০০ টাকা, লেয়ার ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, হাট থেকে গরুর কিনে বাজারে আনা পর্যন্ত চাঁদাবাজিসহ নানা হয়রানির মুখোমুখি হতে হয় মাংস ব্যবসায়ীদের। তবে এসব হয়রানি বন্ধ করতে পারলে ৫০০ টাকার নিচে এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরো আগে থেকে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। বর্তমানে সরকারের সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়ের মতো অবস্থা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close