নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ মার্চ, ২০২৪

কড়াকড়িতেও থামছে না ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি

ট্রেনের টিকিটে কালোবাজারি চলছেই। চলছে জাল টিকিট বিক্রিও। বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে ভাড়ার নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। যার কোনো প্রমাণ থাকছে না। টিকিট বিক্রিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র বেড়ে গেছে এই সিন্ডিকেট সদস্যদের দৌরাত্ম্য।

‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’-এ স্লোগান সামনে রেখে গত বছর ১ মার্চ থেকে অনলাইনে ও অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। টিকিট ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণে জরিমানা করা এবং ভাড়া আদায় সহজ করতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও নতুন নতুন কৌশলে চলছে টিকিট কালোবাজারি।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারও ঈদযাত্রার টিকিট অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকেই শতভাগ টিকিট বিক্রি হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একটি মোবাইল ফোন থেকে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট সংগ্রহ করার সুযোগ থাকবে। টিকিট সংগ্রহের সময় প্রত্যেক মোবাইল ফোনে আলাদা আলাদা ওটিপি যাবে। সেটি নিশ্চিত করার পরই যে কেউ টিকিট কাটতে পারবেন। ওটিপি পাঠানোর এ পদ্ধতি নতুন চালু হওয়ায় টিকিট নিয়ে কারসাজি অনেকটা কমবে বলে মনে করছেন রেল কর্মকর্তারা। অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরুর পর কালোবাজারি কমবে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি।

ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, ঈদযাত্রায় বা অন্য কোনো উৎসবে অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরুর ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত কিংবা তারও বেশি সময় ধরে সার্ভারে ঢোকা যায় না। আবার সার্ভারে ঢোকার পর দেখা যায় সব টিকিট বিক্রি শেষ। এ ক্ষেত্রে টিকিট বিক্রির সার্ভারটি ইচ্ছে করে ডাউন করে রাখা হয়। পাশাপাশি সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট সংগ্রহ করে পরে তা স্টেশনে, ফেসবুকের মাধ্যমে কিংবা নানা মাধ্যমে যাত্রীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে। সম্প্রতি ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সরাসরি ট্রেন চালুর পর এ রুটে ট্রেনের টিকিটের ব্যাপক চাহিদা থাকায় টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায়।

রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম এ বিষয়ে বলেন, ‘টিকিট বিক্রি শুরুর পর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সার্ভার ডাউনের কারণে সাইটে প্রবেশ করা যায় না। এগুলো সব সত্যি। এই টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে একটি সিন্ডিকেট জড়িত। যাদের সঙ্গে সহজের লোক এবং আমাদের রেলের লোকও জড়িত। এরই মধ্যে আমরা দুটি সিন্ডিকেটকে ধরে আইনের আওতায় এনেছি। ঠিকমতো টিকিটিং ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য সহজকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিকিট কালোবাজারি বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না।’

দেশব্যাপী ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে গত ২৬ জানুয়ারি ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ২২৪টি ট্রেনের টিকিট জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা রেলস্টেশনে কর্মরত অসাধু কর্মচারী, সহজ ডটকমের অসাধু কর্মকর্তা এবং সার্ভার রুম ও আইটি শাখার কর্মীদের সহযোগিতায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করত বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ দিনে রেলওয়ের তিনজন বুকিং সহকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। টিকিট কাটার জন্য তারা কালোবাজারি ও দালালদের সরবরাহ করা অজ্ঞাতপরিচয় নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করত। এ ছাড়া স্টেশনের টিকিট কাটতে আসা যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও মোবাইল ফোন নম্বর ডায়েরিতে টুকে রাখত। তারপর সময় সুযোগমতো সেসব পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে টিকিট কেটে কালোবাজারিদের হাতে তুলে দিত।

২০২২ সালের জুলাই মাসে রেল খাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী মো. মহিউদ্দিন হাওলাদার ওরফে রনির করা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় সহজ ডটকমকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কমলাপুর ও সবুজবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে সহজ ডটকমের কয়েকজন কর্মীসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে সহজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মালিহা এম কাদির এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহাত আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

গত বছরের মাঝামাঝিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দল ছদ্মবেশে বিভিন্ন রুটের ট্রেনে অভিযান চালিয়ে টিকিট ছাড়া যাত্রীদের ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়ে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। অবৈধ এ অর্থ আদায়ের সঙ্গে রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) ও ট্রেনে খাবার সরবরাহে নিয়োজিত বেসরকারি ক্যাটারিংয়ের লোকজন জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পায় দুদক। এর আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের ১০টি দুর্নীতির খাত চিহ্নিত করে দুদক। দৃশ্যমান রেলের টিকিট কালোবাজারি অন্যতম।

সরেজমিন দেখা গেছে, ট্রেনে ওঠার সময় কিংবা আসনবিহীন যাত্রীদের কাছে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ ও ক্যাটারিংয়ের লোকজন টিকিট আছে কি না জানতে চান। নাই বললে, তারা তখন অভয় দিয়ে বলেন, ‘সমস্যা নেই, আমরা দেখব।’ এরপর দরদাম করে তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়। আবার অনেক যাত্রী আছেন যারা এভাবে যাতায়াতে অভ্যস্ত তারা নিজেরাই তাদের সঙ্গে দরদাম ঠিক করে নেয়। যারা এসবের মধ্যে যান না তাদের জরিমানা করা হয়।

টিকিট কালোবাজারির পাশাপাশি জাল টিকিট বিক্রিরও প্রমাণ মিলছে সাম্প্রতিক সময়ে। কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে টিকিট কাটার পর পিডিএফ কপি রেখে দেওয়া হয়। এ কপি এডিট (সম্পাদনা) করে নতুন আসন বসানো হয়। এমনকি কাউন্টার থেকে কাটা টিকিট স্ক্যান করে সম্পাদনার মাধ্যমে ইচ্ছেমতো আসনও বসানো হয়। এভাবেই ট্রেনের জাল টিকিট বিক্রির ডিজিটাল অপরাধী চক্র এখন সক্রিয়। এতে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। আবার অনেকেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আর্থিক জরিমানা ও কারাদণ্ডের মুখোমুখি হন।

কালোবাজারি চক্র এখন নতুন পদ্ধতি হিসেবে টিকিট রিফান্ড (ফেরত দিয়ে নতুন টিকিট সংগ্রহ) করে ফের টিকিট নিয়ে তা বিক্রি করছে। অর্থাৎ তারা আগেই টিকিট কেটে রাখে। এরপর যাত্রী জোগাড় করে কোনো এক ফাঁকে কাউন্টারে গিয়ে টিকিট রিফান্ড করেই সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর এনআইডি, নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে টিকিট করে দিচ্ছে। ফলে ট্রেনে যাত্রীর টিকিট পরীক্ষা করলেও তা যে কালোবাজারিদের কাছ থেকে কেনার তা আর ধরার উপায় থাকে না।

রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রেনের মধ্যে বিনা টিকিটের যাত্রী শনাক্ত করতে সারা দেশে অন্তত ৫০০ জন ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) দরকার হলেও আছে মাত্র ২১৫ জন। এ ছাড়া স্টেশনে টিকিট চেক করার জন্য টিসির সংখ্যাও নগণ্য। এসব কারণেও সব যাত্রীর টিকিট যাচাই করা সম্ভব হয় না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close