মেহেদী হাসান

  ২৪ মার্চ, ২০২৪

তোয়াক্কাহীন ব্যবসায়ীরা

চলতি মাসের ১৫ তারিখ কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মাছ, মাংস, ডিম, ডালসহ ২৯ পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়ার ৮ দিন পরও অধিকাংশ পণ্য বিক্রি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছামতো। তাদের ভাষ্য, দাম বেঁধে দেওয়া ‘কল্পনাপ্রসূত’। এই দামে তারাই পণ্য পাচ্ছেন না। কিনতে গেলে পণ্যের সংকট দেখা যাচ্ছে। পাইকার পণ্য মজুদ করছে, দিচ্ছে না। তাই বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি সম্ভব না। ফলে নিজেদের কথাই রাখলেন ব্যবসায়ীরা।

ঢাকার মগবাজারে দোকান মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় দপ্তরে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়। সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, মহাসচিব জহিরুল হক ভূইয়া সংবাদ সম্মেলনে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরও বলছে, পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও ব্যবসায়ীরা তা মানতে নারাজ। তারা আগের দামেই বিক্রি করছে পণ্য। অবশ্য বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে মাত্র ৮টি পণ্য বিক্রি হতে দেখা গেছে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার, মগবাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত দামে ২১টি পণ্য বিক্রি হচ্ছে না।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নির্ধারিত মূল্য তালিকায় দেখা যায়, খেসারি ডাল নির্ধারিত মূল্য ৯২.৬১ টাকা যা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, অর্থাৎ খেসারি ডাল কেজিতে ৪৭ টাকা ৩৯ পয়সা বেশি। গরুর গোশত নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ৬৬৪.৩৯ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির নির্ধারিত মূল্য ১৭৫.৩০ টাকা কিন্তু ২১০ থেকে ২২০ টাকা গুনতে হচ্ছে, সোনালি মুরগির নির্ধারিত মূল্য ২৬২ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়, অর্থাৎ কেজিপ্রতি ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ছোলা খুচরা পর্যায়ে ৯৮.৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা বাজারে এখনো বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়, অর্থাৎ ছোলায় কেজি প্রতি ১১ টাকা ৭০ পয়সা বেশি। মসুর ডালের নির্ধারিত মূল্য (চিকন) ১৩০.৫০ হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, এখানে বেশি নেয়া হচ্ছে সাড়ে ৯ টাকা। একইভাবে মসুর ডাল (মোটা) সরকারের বেঁধে দেয়া দাম ১০৫.৫০ টাকা, অথচ তা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।

প্রতি পিস ডিমের দাম ১০.৪৮ টাকা নির্ধারণ হলেও বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়। দেশি রসুন প্রতি কেজির নির্ধারিত মূল্য ১২০.৮১ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা, আমদানিকৃত আদা প্রতি কেজির নির্ধারিত মূল্য ১৮০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। ফলে ২০ টাকা বেশি মূল্যে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি দরে। শুকনো মরিচ প্রতি কেজি নির্ধারিত মূল্য ৩২৭.৩৪ টাকা অথচ বাজারে ৭৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। কাঁচামরিচ নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ৬০.২০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, বাঁধাকপির নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ২৮.৩০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়, আলুর নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ২৮.৫৫ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়। টমেটো প্রতি কেজি নির্ধারিত মূল্য ৪০.২০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। মিষ্টিকুমড়া প্রতি কেজি নির্ধারিত মূল্য ২৩.৩৮ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, জাহিদি খেজুর প্রতি কেজির নির্ধারিত মূল্য ১৮৫.০৭ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়, অর্থাৎ এ জাতের খেজুর কেজি প্রতি প্রায় ৩৫ টাকা বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। কলা প্রতি হালি নির্ধারিত মূল্য ২৯.৭৮ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, বাজারে গত বছরের তুলনায় এবার রোজায় মোটা দাগে ১০টি পণ্যের দাম বেড়েছে। দামের তালিকায় থাকা খোলা আটা, চাল, ছোলা, পেঁয়াজ, দেশি রসুন, সয়াবিন তেল (বোতল), চিনি, মসুর ডাল (বড় দানা), অ্যাংকর ডাল, দেশি শুকনা মরিচ, গরুর মাংস, ডিম (হালি), রুই মাছ, ব্রয়লার মুরগি ও খেজুরের দামসহ ১৫টি পণ্যের মাত্র ৫টির দাম কমেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার অনুসানে গত বছর যে পণ্য ১০০ টাকায় পাওয়া যেত তা এবছরের ফেব্রুয়ারিতে গুনতে হয়েছে ১১০ টাকা। অবশ্য মানুষের আয় বেড়েছে ৭.৭৮ শতাংশ যা মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় কম।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরের মধ্যে এবারই রোজার বাজারে চিনি, খেজুর, ছোলা, পেঁয়াজ ও অ্যাংকর ডালের দাম সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে রোজার আগে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। এ বছর চিনির কেজি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। তাতে এক বছরে চিনিতে খরচ বেড়েছে সর্বনিম্ন ৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ টাকা।

কারওয়ানবাজারের সবজি বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সবজির দাম তুলনামূলক কমেছে। অন্য জিনিসের দাম কমানোর দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। আলু ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি এখন ৪০ টাকা। বেগুন ৫০ টাকা কেজি বিক্রি করলেও এখন ৪০ টাকা। পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা থেকে কমে এখন ৬০ টাকায় নেমেছে।

পেঁয়াজ বিক্রেতা মাইদুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ৩০০ টাকা পাল্লা (পাঁচ কেজি) বিক্রি করছি। পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও বেশিদিন কম থাকবে না। আমাদের দেশের কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছে। খুচরায় একটু বেশি দামে বিক্রি হতেই পারে। তবে দামের অভিযান সারা বছরই হয় এটা নতুন কিছু নয়। ক্রেতা অসিম কুমার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, লাউয়ের দাম কমেছে। ৮০ টাকার লাউ এখন ২০ টাকা। পেঁয়াজের কেজিতে ২০ টাকা কমেছে। সবজির দামও কম আছে। কিন্তু চাল, ডাল, তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের দাম কমতে হবে। সরকারের কথা ব্যবসায়ীরা শুনে না এটা নতুন কিছু নয়।

বড় দু-একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ছোটরা ঠিক হয়ে যাবে। আবার খোলাবাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। এটা নতুন কিছু নয়। ক্রেতা অসিম কুমার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, লাউয়ের দাম কমেছে। ৮০ টাকার লাউ এখন ২০ টাকা। পেঁয়াজের কেজিতে ২০ টাকা কমেছে। সবজির দামও কম আছে। কিন্তু চাল, ডাল, তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের দাম কমতে হবে। সরকারের কথা ব্যবসায়ীরা শুনে না এটা নতুন কিছু নয়। বড় দু-একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ছোটরা ঠিক হয়ে যাবে। আবার খোলাবাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।

জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তৌহিদ মো. রাশেদ খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমরা খুচরা-পাইকারি ব্যবসায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তর, টিসিবি প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করে ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। বাজারে অনেক পণ্য নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে। সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আমরা দাম নির্ধারণ করে দিয়ে অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। যেন অতিরিক্ত বেশি দামে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে না পারে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় পণ্যের সরবরাহ ও ভোক্তার চাহিদার ওপর। এই দুটি বিষয় না মেনে সরকারের যে দপ্তর পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তাদের ব্যর্থতা। সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি না করে আলোচনার মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করা যৌক্তিক নয়। এতে কোনো ফল আসবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close