নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ মার্চ, ২০২৪

পাঁচ সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে শাপলা বেগম

গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ একজনের মৃত্যু

শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সোলায়মান মোল্যা (৪৫) স্ত্রী শাপলা বেগমকে (৪০) নিয়ে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার হাট বায়রা গ্রাম থেকে জীবিকার তাগিদে গাজীপুর এসেছিলেন। কালিয়াকৈর এলাকায় ভাড়া থেকে ভাঙাড়ির ব্যবসা করতেন। শাপলা বেগমও দিন হাজিরাতে কাজ করেন। তাদের এক ছেলেও কাজ করেন পোশাক কারখানায়। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে চলছিল তাদের টানাপোড়েনের সংসার। তবুও চোখে ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।

কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচলা এলাকায় বুধবার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহত হয়ে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন সোলায়মান মোল্যা। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে মারা যান তিনি। সোলায়মান সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার হাটভায়েরা গ্রামের হোসেন মোল্লার ছেলে।

বার্ন ইনিস্টিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল জানান, সোলায়মানের শরীর ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। তিনি হাসপাতালটির আইসিইউ ইউনিটের পাঁচ নম্বর বেডে ভর্তি ছিলেন।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সার্জন ডা. মৃদুল কান্তি সরকার জানান, গাজীপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শুক্রবার সকালে বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে মারা যান সোলায়মান মোল্লা। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। এছাড়া আজিজুল নামে একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিরা এখনো হাসপাতালে ভর্তি।

শুক্রবার দুপুরে বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে বিলাপ করছেন সোলায়মানের স্ত্রী শাপলা। তাকে ধরে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছেন সোলায়মানের ভাগনি আয়েশা। কাঁদতে কাঁদতে শাপলা বেগম বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ডিউটিতে ছিলাম। ইফতারের জন্য বাসায় আইসা দেহি পোড়া মানুষগুলারে হাসপাতালে নিয়া গেছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে জানতে পারি আমার স্বামীরে হাসপাতালে নিয়া গেছে। আমি দ্যাশের বাড়িতে দুই লাখ টাহা ঋণ আছি। করোনার আগে ঋণ নেওয়া ছিল। করোনার লাইগ্যা ঠিকমতো ব্যবসায়ও হয় নাই। এই পাঁচ ছেলে-মেয়েরে ফালাইয়া চইলা গেল উনি। আমি এহন কী করবো?’

পাশেই কাঁদছিল ১০ বছরের মেয়ে আঙ্গুরি। কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। এক সময় কান্নাকাটি করার শক্তিও হারিয়ে ফেলে আঙ্গুরি। মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ডাক আসে। সই করে মরদেহ নিয়ে যেতে বলা হয় সোলায়মানের স্বজনদের। কাঁদতে কাঁদতেই বাবার মরদেহ আনতে যান ছেলে আকাশ।

সেখানে উপস্থিত থেকে নিহতদের স্বজনদের সান্ত¡না দিতে দেখা যায় এক নারীকে। তার পরিচয়ের খোঁজ করলে জানা যায়, তিনি কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচলা এলাকায় শফিকুল ইসলামের স্ত্রী নাজনিন বেগম। এ শফিকুল ইসলামই ঘরে সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেলে পাশের একটি দোকান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার কিনে এনে ঘরের ভেতরে চুলার সঙ্গে নিজেই সংযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সিলিন্ডারের চাবি ভেঙে যায়। এতে গ্যাস ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন তিনি সিলিন্ডারটি বাইরে ফেলে দেন। ফেলে দেওয়ার পরও সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় পাশের অন্য একটি ঘরের লাকড়ির চুলার আগুন গ্যাসের সংস্পর্শে এলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আশপাশের ঘরে ও বাইরে থাকা লোকজনের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ৩৪ জন দগ্ধ হন।

নাজনিন বেগম বলেন, ইফতারের সময় গ্যাস শেষ হয়ে গেলে নতুন গ্যাসের সিলিন্ডার আনেন তার স্বামী। কিন্তু সিলিন্ডার নষ্ট হয়ে গেলে গ্যাস বের হতে থাকে। পরিবারের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তার স্বামী গ্যাসের সিলিন্ডারটি বাইরে রাখেন। সবাইকে তিনি সতর্কও করেন সিলিন্ডারের কাছ থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু অতি উৎসাহীরা সিলিন্ডারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। একপর্যায়ে আগুন লেগে যায়।

সিলিন্ডার মেরামত বা বদলাতে সংশ্লিষ্টদের ডাকেননি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের ফোন নম্বর আমাদের কাছে ছিল না। আমরাও বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে। আল্লাহ যদি তাদের হায়াত না দেয়, তাহলে তো কিছু করার নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close