প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২১ জুন, ২০২২

নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

বকশীগঞ্জে পানিবন্দি হয়েছে ১০ হাজার মানুষ

আবারও পানি বেড়ে তিস্তা বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে, বাড়ছে বন্যার বিস্তার। বৃষ্টির পানিতে ধসে গেছে কুড়িগ্রামের চিলমারীর একটি আশ্রয়ণকেন্দ্র। আর পানিবন্দি হয়েছে ৫০ হাজার মানুষ। এদিকে, টাঙ্গাইলে ১১৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, সিরাজগঞ্জে তাঁত কারখানা প্লাবিত হওয়ায় শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। শাহজাদপুরের রাউতারা রিং বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ফসলি জমি। জামালপুরের বকশীগঞ্জে পানিবন্দি হয়েছেন ১০ হাজার মানুষ। উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। অপরদিকে, বন্যার্তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বাস ভাড়া নেওয়ায় আটজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট :

লালমনিরহাট ও ডিমলা (নীলফামারী) : গত সপ্তাহ থেকে লালমনিরহাটের তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, সানিয়াজান নদীর পানি ওঠানামার মধ্যে রয়েছে। তিস্তার পানি গত শনিবার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার উপরে উঠলে গত রবিবার তা নেমে ৫ সেন্টিমিটারের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তার পানি ফের বেড়ে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটারের উপর দিয়ে বইছে। গতকাল সোমবার দুপুর ১২টায় তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে এবং ধরলার শিমুলবাড়ি পয়েন্টে এ পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এভাবে পানি হ্রাসবৃদ্ধির মধ্যে থাকলেও তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চলে বন্যার বিস্তার লাভ করছে।

নতুন করে পানি বাড়ায় এসব এলাকায় বন্যার বিস্তার ঘটছে। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বানভাসি মানুষ। আদিতমারী মহিষখোচা এলাকার লোকমান হোসেন বলেন, কয়েক দিন থেকে পানি বাড়ছে আর কমছে। কষ্টে দিন কাটছে।

আদিতমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মফিজুল ইসলাম বলেন, উপজেলার মহিষখোচা, দুর্গাপুর, ভাদাই ইউনিয়নের পানিবন্দি লোকজনের তালিকা করে সাহায্য করা হচ্ছে। বন্যাদুর্গতদের সব সহযোগিতা অব্যাহত আছে। নতুন করে বন্যার বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি।

এদিকে তিস্তা বন্যায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার ২৫টি চর ও গ্রামের প্রায় ২০ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। নিচু জমিতে পানি আটকে চলতি মৌসুমের ফসল তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে বন্যাকবলিত পরিবারগুলো।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, বন্যা পরিস্থিতিতে সার্বিক নজর দিচ্ছে প্রশাসন।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) : কুড়িগ্রামের চিলমারীতে হস্তান্তরের আগেই বৃষ্টিতে ধসে গেছে কোটি কোটি টাকায় নির্মিত আশ্রয়ণকেন্দ্র ও ব্যারাক। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তরা। এলাকাবাসী বলছেন, মাটি ভরাট ও ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চিলমারি ইউনিয়নের করাইবড়িশাল আশ্রয়ণ কেন্দ্রের মাটি ধসে ২টি ব্যারাকের আটটি রুম ভেঙে পড়ে। এছাড়াও ভাঙনের মুখে রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যারাক। বন্যা থেকে রক্ষা পেতে ব্যারাকে সদ্য আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি পরিবার রক্ষা পেলেও এখনো ভয় কাটেনি তাদের। এছাড়াও ধস দেখা দিয়েছে একই ইউনিয়নের ঢুষমারা এলাকার দুটি আশ্রয়ণকেন্দ্রে। কড়াইবড়িশাল আশ্রয়ণকেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মোরশেদা বলেন, ধসে যাওয়া ঘরেই ছিলাম। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। এই আশ্রয়ণে থাকতে আর মন চাচ্ছে না। চিলমারী ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, আপাতত মাটি ভরাট করে আশ্রয়ণের বাকি ব্যারাকগুলো রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে।

এদিকে, পানি বাড়তে থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক এলাকা। তলিয়ে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। প্রায় এক সপ্তাহ থেকে পানিবন্দি আশ্রয়ণবাসীর মাঝে মেলেনি কোনো সহায়তা, বাড়ছে দুর্ভোগ। তাদের মধ্যে বাড়ছে ভয় ও হতাশা।

তলিয়ে গেছে উপজেলার জোড়গাছ বাঁধ এলাকায় সদ্য নির্মাণ হওয়া প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো। একই স্থানে গড়ে ওঠা ১৫টি পরিবারের জন্য ১৫টি ঘর নির্মাণ করা হলেও বের হওয়ার কোনো রাস্তা না থাকায় বিপাকে রয়েছেন তারা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, সরেজমিনে ঘুরে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় বিপৎসীমার ৫২ সেমি উপর দিয়ে বইছে। এর ফলে উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তারা উঁচু বাঁধের ওপর আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ, শুকনো খাবার, নিরাপদ পানি ও গবাদি পশুর খাদ্যের চরম সংকটে রয়েছেন। তবে প্রয়োজনীয় খাবার মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে পানি বেড়ে জেলার ছয়টি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের প্রায় ১১৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে সর্দি-জ্বর দেখা দিচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি পোড়াবাড়ী পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে, ঝিনাই নদীর পানি জোকারচর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। এছাড়াও ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিন পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। বিভিন্নস্থানে নদীভাঙনও দেখা দিয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকার অন্তত ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। পৌর এলাকার পুঠিয়াবাড়ি, চরমালশাপাড়া এবং কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের চররামগাতী, পাইকপাড়া, মোড়গ্রাম; সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব মোহনপুর, পূর্ব বাঐতারাসহ বাঁধ অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। যমুনার পানি ২৪ ঘণ্টায় ১১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। সয়দাবাদ ইউনিয়নের বাঁধ অভ্যন্তরে পানি উঠায় সেখানকার তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজের অভাবে তাঁত শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নিম্নাঞ্চল ডুবে তিল, কাউন, বাদাম, পাট ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে।

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) : ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি নিমাইচড়া রিং বাঁধ ভেঙে গেছে। শাহজাদপুর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বাঘাবাড়ি নিমাইচড়া রিং বাঁধটির অবস্থান। এই বাঁধটি ভেঙে পড়ায় পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ইমতিয়াজ হোসেন টেলিফোনে জানান, বৃহত্তর চলনবিল এলাকার ৬২ হাজার হেক্টর জমির ফসল রক্ষার্থে শাহজাদপুর বাঘাবাড়িতে স্বল্পউচ্চ বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) : ব্রহ্মপুত্র নদ, দশানী নদী ও জিঞ্জিরাম নদীর পানি বেড়ে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া, মেরুরচর ও বগারচর ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সাধুরপাড়া ইউনিয়নের ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠায় পাঠদান বন্ধ রেখেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নতুন করে নিলাখিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মেরুরচর ইউনিয়নের কলকিহারা, চিনারচর, ভাটি কলকিহারা; সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কুতুবের চর, বাঙ্গালপাড়া, চর আইরমারী, খান পাড়া গ্রামে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৫০ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

হবিগঞ্জ : সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে আসা বন্যার্তদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বাস ভাড়া নেওয়ার অভিযোগে চারটি বাসের চালক ও কন্ট্রাক্টরসহ মোট আটজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন হবিগঞ্জ মোটর মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক শঙ্খ শুভ্র রায়।

তিনি জানান, গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবর নিয়ে তদন্তে নামে হবিগঞ্জ মোটর মালিক গ্রুপ। প্রমাণ পাওয়ায় রোববার রাতে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়াও অভিযুক্ত ৯টি গাড়ির আরো ১৮ শ্রমিকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদেরও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

এদিকে, খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় হুমকির মুখে রয়েছে হবিগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ। বন্যাসহ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় শহরবাসীকে সতর্ক থাকতে মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন। সোমবার দুপুর থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close