জুবায়ের চৌধুরী

  ১৮ আগস্ট, ২০১৯

জঙ্গি গোষ্ঠীর শক্তি কমলেও ঝুঁকি কমেনি

১১ হত্যার পরিকল্পনায় পলাতক জিয়া

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা করে রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ১৪ বছর আগে এমন সন্ত্রাসী ঘটনার পর সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এর পরপরই উত্থান ঘটে নব্য জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলামের মতো নতুন নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী। নামে ভিন্নতা থাকলেও, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন, দেশে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করা। এরই মধ্যে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গিদের অনেক হোতা নিহত হয়। অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যায়। স্তিমিত হয়ে আসে জঙ্গি কার্যক্রম। সাংগঠনিকভাবে জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ভেঙে পড়লেও, এখনো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। বিভিন্ন সময় নিত্যনতুন নামে তাদের আবির্ভাব ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার হাসান আল মামুনের (ল্যাংড়া মামুন) মৃত্যুদ- কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে। এরপর হবিগঞ্জের মাওলানা সাইদুর রহমান জেএমবির হাল ধরে। কিন্তু সে গ্রেফতার হওয়ায় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে জেএমবি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত তৎপরতায় আর সক্রিয় হতে পারেনি জেএমবির নেতাকর্মীরা। তবে ছোট ছোট সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করে অনেকে।

জঙ্গি দমন নিয়ে কাজ করা র‌্যাবের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জেএমবির শক্তি কমলেও উত্থান ঘটছে নব্য জেএমবির। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নব্য জেএমবিই করেছে। সাংগঠনিকভাবে সংঘবদ্ধ হতে না পারলেও সারা দেশে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিরা ছোট ছোট গ্রুপে সংঘটিত হয়ে নাশকতার ছক বাস্তবায়নে সারাক্ষণই কাজ করছে। তবে তাদের সেই শক্তি এখন আর নেই বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

সিটিটিসির প্রধান বলেন, ‘জেএমবির প্রতিষ্ঠাতারা নিজেদের শক্তির জানান দিতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা করে। তাদের নির্মূল করার কথা কখনোই বলিনি। তবে তাদের বড় ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতা এখন আর নেই। নব্য জেএমবিতে যারা এখনো আছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। তারা আর যেন কোনো নাশকতা করতে না পারে, সে জন্যই আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

এদিকে সিরিজ বোমা তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেদিন জঙ্গিরা বেশির ভাগ স্থানেই রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। পরে এসব অভিযোগে সারা দেশে ১৬০টি মামলা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে প্রায় ৯০টি মামলার রায় হয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। তবে ১৪ বছরেও দেশের ইতিহাসে ভয়ংকর এই হামলা-মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ২০০৫ সালের পর জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা ও তাদের সক্ষমতা প্রকাশ্যে আসে। শক্তির জানান দিতেই ভয়ংকর এই সিরিজ বোমা হামলার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল শাহবাগ আন্দোলনে ব্লগারদের হত্যা করে ফের আলোচনায় আসে জঙ্গি গোষ্ঠী। এসব হত্যাকা-ের পরিকল্পনায় ছিলেন সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন সময় তিনি জেএমবি, নব্য জেএমবি ও এবিটির জঙ্গি গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে গুলশানে জঙ্গি হামলা ও পরিকল্পনায়ও তার নাম আসে। পর্যায়ক্রমে গুলশান হামলায় জড়িতদের সবাই বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন। অনেকে গ্রেফতার হন। কিন্তু ভয়ংকর জঙ্গি নেতা মেজর জিয়া এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

১১ হত্যার পরিকল্পনায় সেই জিয়া : জিয়াউল হক ওরফে বরখাস্তকৃত মেজর জিয়া ব্লগার, প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ১১ ব্যক্তিকে হত্যায় সব ধরনের পরিকল্পনা করেন বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশের কাছে তথ্য আছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (এবিটি) প্রধান জিয়া আগের মতো সক্রিয় নেই। এবিটির আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে গ্রেফতারের পরই মূলত জিয়ার তথ্য বের হয়ে আসে। তার হাতেই দায়িত্ব পড়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ও নানা অপকর্মের পরিকল্পনা করার। জঙ্গি হামলা, হত্যাসহ নানা পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। অন্তত ৫০ জন দুর্ধর্ষ কিলারও তৈরি করেন জিয়া। এদের মধ্যে কয়েকজন কিলার বা জঙ্গি গ্রেফতার হলেও অনেকেই এখনো পলাতক।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, মেজর জিয়া কোথায়, তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তাকে ধরতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ। তা এখনো বলবৎ আছে। তবে জিয়া যেন আগের মতো জঙ্গিবাদ উসকে দিয়ে মানুষ হত্যায় মেতে উঠতে না পারে, সে জন্য গোয়েন্দারা কাজ করছে। ব্লগার, প্রকাশক, সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের হত্যার ঘটনাগুলো তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেছে, উগ্রবাদী চিন্তা থেকে হত্যাকা-গুলো হয়েছে। এসবের পরিকল্পনা, কিলার তৈরি, এমনকি অস্ত্রের জোগান দেন জিয়া।

জিয়ার মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে হত্যা পরিকল্পনার অনেক তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকা-ের পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রথমবার মেজর জিয়ার নাম প্রকাশ্যে আসে। ২০১৩ থেকে ১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার ও প্রকাশক এবং সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুই ব্যক্তিকে হত্যা করে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি। এখানেও মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম চলে আসে। একে একে তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে হত্যা, আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপন এবং পল্লবীতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যাকা-ের সবকিছু হয় জিয়ার পরিকল্পনায়।

গ্রেফতারের পর গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এবিটির একাধিক জঙ্গি তাদের স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে, হত্যাকা-গুলো কীভাবে সংঘটিত করতে হবে, কোথায় কিলার গ্রুপের কয়জন অংশ নেবে, তাদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ, ঘটনার পর কীভাবে পালিয়ে আসতে হবে বা ঘটনার আগে স্থানগুলো রেকি করা সবকিছুই মেজর জিয়ার পরিকল্পনায় হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close