জুবায়ের চৌধুরী

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বুড়িগঙ্গা দখলমুক্তের অভিযান অব্যাহত

ছাড় পাচ্ছেন না প্রভাবশালীরা!

একসময় বুড়িগঙ্গা নদীকে বলা হতো রাজধানী ঢাকার প্রাণপ্রবাহ। এই বুড়িগঙ্গা ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। এর তীরে বসেই অনেক কবি-সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। আর এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে। সাহিত্য রচনা তো বহু দূরের ব্যাপার। কালের বিবর্তনে দখল আর দূষণের কবলে হারিয়ে যাচ্ছে চির যৌবনা বুড়িগঙ্গা। কয়েক দশক ধরে বুড়িগঙ্গার দখল ও দূষণ নদীটিকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সরকার দফায় দফায় দখল আর দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রতিবারই অদৃশ্য শক্তির কাছে হার মেনে পিছু হটেছে। কিন্তু এবার টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় বসে বুড়িগঙ্গার যৌবন ফিরিয়ে দিতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে চার দফায় টানা তিন সপ্তাহ ধরে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থাটির এই অভিযানে এরই মধ্যে অনেক প্রভাবশালীর স্থাপনাও এরই মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার দুই তীরে ৬০৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বহুতল ভবন রয়েছে ৫৬টি। দুই বছর আগেও সদরঘাট-গাবতলী রুটে বিআইডব্লিউটিএ অবৈধ স্থাপনার যে তালিকা তৈরি করেছিল, তাতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভবনের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩টি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪টিতে। যার সব কটি বহুতল ভবন। আর সেগুলোসহ আশপাশের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে তা উদ্ধারের জন্য মাঠে নেমেছে সরকার। এতে যত প্রভাবশালী লোকেরই স্থাপনা থাকুক, তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমসহ অনেক প্রভাবশালীর অবৈধ স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এ অভিযানকে পরিবেশবিদসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানিয়েছে, গত তিন সপ্তাহে কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক দখলকারীকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। ক্ষমতা দেখিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে বাধা সৃষ্টি করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হচ্ছে।

বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা বসতবাড়ি ও দোকানপাট ভেঙে ফেলা হচ্ছে। উচ্ছেদ অভিযানে ভেঙে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন ও নদীর পারে গড়ে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অভিযানে বড় বড় ভবন যেমন ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, তেমনি নদী থেকে ময়লা-আবর্জনা তুলে পরিষ্কার করা হচ্ছে। অভিযানে শুধু অবৈধ দখলদার নয়, বুড়িগঙ্গাকে দূষণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, এবার স্থায়ীভাবে নদীর পাড় দখলমুক্ত রাখতে অভিযানের আগেই সীমানাপ্রাচীর এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের মতো দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বুড়িগঙ্গার পারে ইকোপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সরকারের। উচ্ছেদের পরপরই শুরু হবে সীমানাপিলার এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণকাজ। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, সাধারণত স্থাপনা উচ্ছেদের কিছুদিনের মধ্যেই আবার দখল হয়ে যায়। কিন্তু সেটি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ আবার যাতে কেউ দখল করতে না পারে, সে জন্য উচ্ছেদ অভিযানের পরপরই শুরু হবে প্রাচীর ও ওয়াকওয়ে নির্মাণকাজ। বুড়িগঙ্গাকে নতুন রূপ দিতে কাজ করছে সরকার। উচ্ছেদের দ্বিতীয় দিন পরিদর্শনে গিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সামাদ ঘোষণা দেন, নদীদখল-দূষণকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে। ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গাকে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করা ছাড়বে বিআইডব্লিউটিএ। এ ছাড়া উচ্ছেদ অভিযান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নদী তীর ভূমিতে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও নদীর পার সবুজ বেষ্টনীতে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন।

বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, গত ২৯ জানুয়ারি বুড়িগঙ্গার তীরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। প্রথম দিনে ভাঙা হয়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কামরাঙ্গীরচরের খোলামুড়া ঘাটের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা বসতবাড়ি ও দোকানপাটও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রথম দিনের উচ্ছেদ অভিযানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। এ দিন দুটি বহুতল ভবন, ১৬টি পাকা ভবনসহ ১৬৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় নদী দখলের অভিযোগে একজনকে তিন মাসের কারাদ- দেওয়া হয়।

এদিকে অভিযানের দ্বিতীয় দিনে কামরাঙ্গীরচরের ইসলামবাগ থেকে লোহারপুল পর্যন্ত এক কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ দিন অন্তত ১৮টি বহুতল ভবনসহ নদীতীরের ২৫২ অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি ছিল উচ্ছেদ অভিযানের তৃতীয় দিন। এদিন কামরাঙ্গীরচর এলাকায় খোলামোড়া নবাবচর থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। অভিযানে সাত, পাঁচ, তিন ও দোতলা পাকা ভবন, স-মিল, গোডাউন, প্লাস্টিক কারখানা, আধাপাকা ভবন ও ছোট বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

উচ্ছেদ কার্যক্রমের প্রথম পর্যায়ে ২৯-৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছোট-বড় ৪৪৪ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ১৯৯ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তিন দফায় ৯ দিনের অভিযানে বুড়িগঙ্গা তীরের প্রায় ১৫০০’ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএ। আর প্রায় ১০ একর তীরভূমি উদ্ধার করা হয়েছে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বসিলায় চতুর্থ দফা উচ্ছেদ অভিযানের প্রথম দিন ১২০টি অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। যার মধ্যে একটি চারতলা ভবন, আটটি তিনতলা ভবন, ১১টি দোতলা ভবন এবং ৪২টি একতলা ভবন রয়েছে। এ ছাড়া ৩৩টি আধাপাকা এবং ২৫টি টংঘর উচ্ছেদ করা হয়। সর্বশেষে গতকাল মঙ্গলবার চতুর্থ পর্যায়ের অভিযানের দ্বিতীয় দিনে বুড়িগঙ্গা নদীর বসিলা অংশে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। অভিযানের একপর্যায়ে বসিলা আমিন মোমেন হাউজিং এলাকায় উচ্ছেদে বাধা দেন কথিত ছাত্রলীগ নেতা লাবু। আসাদুজ্জামান তালুকদার লাবু নিজেকে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি উচ্ছেদে আগে অবৈধ স্থাপনা পরিদর্শনে গেলে সেখানে বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তাদের বাধা দেন স্থানীয় দুই নেতা। পরে তাদেরও আটক করা হয়।

সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে লাবুকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান। এদিকে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইমুল ইসলাম রাসেল জানিয়েছেন, মোহাম্মদপুর থানায় বা ওয়ার্ডে লাবু নামে কোনো নেতা বা কর্মী নেই। একই কথা জানিয়েছেন তারানগর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা।

নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম থেকেই বড় অভিযান চালাতে মাঠে নেমেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের নদীর ক্ষায় গঠিত টাস্কফোর্সের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযান না চালানোয় দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ ছিল পরিবেশবাদীসহ নগরবাসীর। সম্প্রতি অভিযান শুরুর পর তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। অভিযান শুরুর পর প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ঢাকার চারপাশের সব নদী ও খাল রক্ষায় ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চলবে। উচ্ছেদের পর ফের দখল ঠেকাতে নদীর তীরে বনায়নের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেন, এবারের অভিযানে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কারণ, সবাইকে মনে রাখতে হবেÑ নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close