নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯

লোকাল বাসেও চলছে অবৈধ ‘সিটিং সার্ভিস’

গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিস বলে আইনি বৈধতা না থাকলেও পরিবহন সংকটের ঢাকায় লোকাল বাসও এ সার্ভিস বলে চলছে। সারা দিন ‘লোকাল’ হিসেবে চললেও অফিস সময়ে ‘সিটিং’ হয়ে যাচ্ছে। ফলে জরুরি সময়ে যানবাহন না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আবার সিটিং সার্ভিসের নাম করে অতিরিক্ত ভাড়া নিলেও অনেক বাসে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হচ্ছে, বাড়তি ভাড়া দিলেও তাদের যেতে হচ্ছে দাঁড়িয়ে। যাত্রী ওঠানামার জন্য এসব গাড়ি প্রতিটি স্টপেজেই দাঁড়াচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও সেবা পাচ্ছেন না যাত্রীরা।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহর ও শহরতলির আড়াইশ’ রুটে প্রায় আট হাজার বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। এর প্রায় প্রতিটি রুটেই যাত্রী ভোগান্তি নিত্যদিনের চিত্র। সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মতিঝিল ও সদরঘাট থেকে মহাখালী হয়ে বিমানবন্দর, আবদুল্লাহপুর, গাজীপুরের বিভিন্ন রুটে কয়েকটি পরিবহনের বাস চলে। এসব বাসের মধ্যে সায়েদাবাদ থেকে বলাকা, সদরঘাট থেকে আজমেরী, স্কাইলাইন, গুলিস্তান থেকে গুলিস্তান-গাজীপুর পরিবহন, প্রভাতী-বনশ্রী, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এয়ারপোর্ট পরিবহন লিমিটেড এবং মতিঝিল থেকে গাজীপুর পরিবহন এবং আল মক্কা পরিবহনের বাস চলাচল করে।

এছাড়া প্রগতি সরণি হয়ে চলাচলকারী অনাবিল, সালসাবিল, সুপ্রভাত, রাইদা, ভিক্টর, প্রচেষ্টা, তুরাগসহ প্রায় পরিবহনের বাসই হয়ে গেছে ‘সিটিং সার্ভিস’। বলাকা পরিবহনের ৩০০ বাসের মধ্যে কয়েকটি লোকাল, কয়েকটি সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করত। কিন্তু গত বছরের শেষদিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর এখন সব গাড়িই সিটিং হিসেবে চলছে।

গাজীপুর পরিবহনের বাস এমনিতে লোকাল হিসেবে যাত্রী নিলেও অফিস ছুটির সময় এ পরিবহনের বাসগুলোও সিটিং সার্ভিস হয়ে যাচ্ছে।

মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর এবং সাভার থেকে কালসী রোড সেনানিবাস ফ্লাইওভার হয়ে চলাচলকারী প্রজাপতি, তেঁতুলিয়া, মিরপুর লিংক, পরিস্থান, রবরব, বসুমতি, নূরে মক্কা, অছিম, আকিকসহ সব পরিবহনের বাসই সিটিং সার্ভিস নামে চলছে। তবে কালসী পার হলেই দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে প্রায় প্রতিটি বাসে।

নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড ও সাইনবোর্ড থেকে যাত্রাবাড়ী, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে চলাচলকারী ঠিকানা, মৌমিতা, নীলাচল, লাব্বাইক, রজনীগন্ধা, মনজিল, অনাবিলসহ সব পরিবহনের বাস সিটিং সার্ভিস হয়ে গেছে।

সাইনবোর্ড এলাকায় লাব্বাইক পরিবহনের চালকের সহকারী মামুন বলেন, এটাই এখন নিয়ম। ঢাকা শহরে এখন আর সিটিং আছে? ভাড়াটা খালি নেয় সিটিংয়ের।

সাইনবোর্ড এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মামুনুল হক রাজু বলেন, এরা সিটিং নাম নেয় শুধু বেশি ভাড়া নেওয়ার জন্য। সবাই ঠেসে ঠেসে যাত্রী নেয়। শুধু দুয়েকটা পরিবহন একটু রেহাই দেয়। আজিমপুর থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী মিরপুর লিংক, মিরপুর মেট্রো সার্ভিস, বিহঙ্গ, আশীর্বাদ, সেফটি, উইনার, বিকাশ, ভিআইপি, দেওয়ান, রমজান, বিকল্প পরিবহনসহ সব গাড়িই সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলে।

এর আগে আজিমপুর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত চলাচলকারী ২৭ নম্বর বাসগুলো লোকাল হিসেবে চললেও এখন সেটা বন্ধ। সেই পরিবহনের কয়েকটি বাস ‘ভিআইপি’ পরিবহনের ব্যানারে চলছে। তবে ভিআইপি ছাড়া সব গাড়িতেই দাঁড়ানো যাত্রী বহন করা হয়। মিরপুর মেট্রো সার্ভিসের একটি বাসে আজিমপুর থেকে শ্যামলী পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেছে, গাড়িতে সব সময়ই ১০ থেকে ১২ জন দাঁড়ানো যাত্রী নেওয়া হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে ওই বাসের চালক কামাল হোসেন দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ছাড় থাকায় দাঁড়িয়ে যাত্রী নিতে হয় তাদের।

রোকেয়া সরণি হয়ে চলাচলকারী বিকল্প অটো, মিরপুর লিঙ্ক, বিহঙ্গ, ইউনাইডেট, সময় নিয়ন্ত্রণ, দিশারী, বেস্ট, স্বাধীন, হিমাচলসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলাচল করে। এ কারণে সকালে অফিসগামী যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিশেষ করে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়ার লোকজন বেশি বিপাকে পড়েন।

কারওয়ানবাজার, ফার্মগেট এলাকা থেকেও ঘরমুখো যাত্রীদের একই রকম সংকটে পড়তে হয় বলে জানালেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাদেকুর রহমান। তিনি বলেন, ঢাকায় গণপরিবহনের এ দুর্ভোগ বাড়িয়েছে সিটিং সার্ভিস।

বাড়তি ভাড়া নেওয়াসহ যাত্রী হয়রানির নানা অভিযোগের কারণে বাস মালিকরা ২০১৭ সালের এপ্রিলে ‘সিটিং সার্ভিসে’ বাস চালানো বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর মে মাসে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান শুরু করলে অনেক মালিক সড়কে বাস নামানো বন্ধ করে দেন। ওই অচলাবস্থার মধ্যে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে হাতহাতির ঘটনাও ঘটে বেশ কয়েক জায়গায়। পরে মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেয় বিআরটিএ। ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস চলবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তখন আট সদস্যের একটি কমিটি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সেপ্টেম্বরে ওই কমিটির প্রতিবেদনে সীমিত আকারে সিটিং সার্ভিসের বাস রাখার সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি নগর পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ২৬টি সুপারিশ করা হয় সেখানে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটিং সার্ভিসের মাধ্যমে দীর্ঘদিন চলাচল করে যাত্রীরা অভ্যস্ত হওয়ায় এবং মালিকরা সিটিং সার্ভিস পরিচালনায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করায় সিটিং সার্ভিস এখন সময়ের চাহিদা।

কোনো কোম্পানির কতগুলো গাড়ি সিটিং, কতগুলো নন-সিটিং চলাচল করবে, তা ঠিক দেওয়ার দায়িত্ব আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি হাতে দেওয়ার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। এরপর ২০১৮ সালের মে মাসে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সেখানে বলা হয়, ঢাকার ২১টি রুটের ১ হাজার ৫৩টি বাসের ওপর জরিপ চালিয়ে তারা দেখেছে, ৯৬ শতাংশ গাড়িই সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করছে।

সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, গত এক বছরে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। কারণ যাদের আইনের প্রয়োগ করার কথা তারা ঠিকমতো তা করছে কিনা তার প্রতিফলন আমরা দেখছি না। এজন্য পরিবহন মালিকরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সিটিং সার্ভিস বিষয়টিই অনুমতিবিহীন। এটাকে আমরা একটা নিয়মের মধ্যে আনতে চেয়েছিলাম। আমরা একটি কমিটি করে সুপারিশও করেছি। সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। কেন তা হয়নি, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ।

বিআরটিএর পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানী বলেছেন, সিটিং সার্ভিসের নামে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা নেন। অভিযোগ না পেলে তাদের করার কিছু থাকে না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, আমরা বিষয়টি দেখছি। সব সিটিং হলে লোকজন যাবেটা কোথায়। আমাদের আইনে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আছে, এদের বিষয়ে তা নেওয়া হবে। এটা নেওয়া হচ্ছেও। অবৈধভাবে কেউ কিছু করতে পারবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close