নিজস্ব প্রতিবেদক
রাস্তায় বেপরোয়া বাস প্রাণ যাচ্ছে নিরীহদের
শাহবাগে বাসের চাপায় পথচারীর মৃত্যু
শুরুটা নিজেদেরই শ্রমিকের প্রাণ নিয়ে। আর গতকাল বুধবার আরেক প্রতিষ্ঠানের চালককে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এর মধ্যে ঘটে আরো দুই বড় ঘটনা রাজীব রোজিনার মৃত্যু। এ ছাড়া ছোট-বড় অসংখ্য ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। এভাবেই রাজধানীতে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই। বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চলাচল, পাল্লাপাল্লির কারণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। যাদের সংসারে কর্মক্ষম ব্যক্তিই হয়ত ছিলেন তিনি। যত্রতত্র থামা, ওঠা-নামা করানো, ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন, বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহনের সাধারণ চিত্র। এদের কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কারণ, এসব পরিবহন ব্যবসা ও এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন প্রভাবশালীরা। এদিকে এক প্রতিবেদনে বিবিসি বলছে ঢাকাকে পথচারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। পুলিশের হিসেব মতে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার প্রায় সবাই পথচারী। ঢাকার যেকোনো ব্যস্ত এলাকার চিত্র হলোÑ লম্বা ট্রাফিক সিগনাল ছাড়লেই যতো জোরে সম্ভব যানবাহন ছুটতে শুরু করে। আর রাস্তার দু’ধার দিয়ে মিছিলের মতো অবিরাম চলেছে শত শত পথচারী। তবে ফুটপাথে নেই এই পথচারীদের বেশির ভাগই। কেননা ফুটপাথ সেখানে থেকেও নেই। ঢাকার বাসিন্দাদের মতে এটিই শহরের পথচারীদের ঝুঁকির সবচেয়ে বড় কারণ।
সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, রাস্তার ওপর দোকানপাট ও বেচাকেনা পথচারীদের ঝুঁকির অন্যতম কারণ। লম্বায় ঢাকা শহর ২০ কিলোমিটার অন্যদিকে আড়াআড়ি ৯ কিলোমিটার। এই সামান্য জায়গায় বাড়ছে গাড়ি, মানুষজন ও ব্যবসায়িক কর্মকা-। ফলে এতে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। সড়ক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহউদ্দিন বলেছেন, ঢাকার পরিকল্পনায় পথচারীদের সর্বাধিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে কিন্তু যখন এর বাস্তবায়ন হতে শুরু করলো তখন পথচারীদের প্রয়োজনের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। ঢাকায় যত দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশির ভাগের জন্য দায়ী বাস।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার রাজধানীর শাহবাগে দুই বাসের চাপায় পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম ওমর ফারুক। তিনি বারডেম হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের এক চিকিৎসকের গাড়িচালক ছিলেন। চাঁদপুরের মতলবে তার বাড়ি। সকালে শাহবাগে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুটি বাসের মাঝে চাপা পড়ে ফারুক গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শাহবাগ এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. সারওয়ার বলেন, ওমর ফারুক সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় মেসকাত পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাস তাকে চাপা দেয়। বাসটির চাকা ওমর ফারুকের মাথার ওপর দিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, ঘটনার পর ওয়্যারলেসে খবর দেওয়া হয়। সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে বাসটিকে থামিয়ে চালক আমিরুল ইসলামকে আটক করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। পরে বাসটিও জব্দ করা হয়। পরে চালক ও বাসটিকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। মেসকাত পরিবহনের বাস মোহাম্মদপুর থেকে যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড রুটে চলাচল করে।
এর আগে গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর সায়েদাবাদে কাইয়ুম (২৬) নামে এক পরিবহন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। সায়েদাবাদ স্টেশনের রেলক্রসিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সিলেটগামী সুরমা পরিবহনের হেলপার কাইয়ুম যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছিলেন। এ সময় আরেকটি যাত্রীবাহী বাস তাকে ধাক্কা দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় সহকর্মী তাজউদ্দিন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আর গত রোববার গুলিস্তানে মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাসের চাপায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঝুমুর আক্তার রাখি (৩২) নামে এক নার্সের পায়ের পাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সেবিকা। গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্সের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবু রাশেদ জানান, শনিবার রাতে গুলিস্তান মোড়ে পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলেন ঝুমুর আক্তার। এ সময় দয়াগঞ্জ থেকে মোহাম্মদপুর গামী মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাসের চাকার নিচে পড়ে ঝুমুরের ডান পায়ের পাতা।
চলতি মাসের ২ তারিখে ঘটে আরেক ঘটনা। সেদিন রাজধানীর মিরপুরে বাসের চাপায় সৈয়দ মাসুদ রানা (২৩) নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। মাসুদ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী। তাকে বহনকারী রিকশাচালকও ওই ঘটনায় আহত হন।
গত কয়েক মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুর অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এর মধ্যে তিতুমীর কলেজের মেধাবী ছাত্র রাজিব হোসেনের মৃত্যুর ঘটনা গোটা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। দুটি বাসের বেপরোয়া গতির কবলে পড়ে রাজিব তার ডান হাত চলে যায়। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত তিনি না ফেরার দেশেই চলে যান। ৫ এপ্রিল নিউমার্কেট ফুটওভার ব্রিজে কাছে দুই বাসের চাপায় আয়েশা খাতুনের মেরুদ- ভেঙে যায়। তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এ ছাড়া গত ১৫ জুন শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে শাহবাগের দিক থেকে আসা সদরঘাটগামী লোকাল ৭ নম্বর বাস বেপরোয়া গতিতে ছুটে এসে কাকরাইল মোড়ের আগেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আইল্যান্ডে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার ওপর উল্টে যায়। এতে দুজন মারাত্মকভাবে আহত হন।
১৭ মে শনির আখড়ায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে বাসের ধাক্কায় মারা যান ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন। পরিবারের উপাজর্নক্ষম লোকটিকে হারিয়ে এই পরিবারটিও অনেকটা বিমূঢ় সময় পালন করছে।
বনানিতে বাসের চাপায় পা হারানো রোজিনা আক্তারও মারা গেছেন। এভাবেই বেপরোয়া বাসের কারণে সড়কে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
"