প্রতীক ইজাজ

  ০৭ এপ্রিল, ২০১৮

এবার তালিকা নিয়ে জটিলতা

কিছুতেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিচ্ছে না মিয়ানমার

প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কিছুতেই ফিরিয়ে নিচ্ছে না মিয়ানমার। এ ব্যাপারে সম্পাদিত দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবসহ দফায় দফায় বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ও নানা ধরনের অবরোধ- কিছুই মানছে না দেশটি। এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ন্যূনতম কোনো সদিচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে না দেশটির। সর্বশেষ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেওয়া তালিকাও মানছে না দেশটি। ওই তালিকা অনুযায়ি ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র ৫৭০ জনকে ফিরিয়ে নিতে সম্মতি হয়েছে দেশটি।

ইতোমধ্যেই তা বাংলাদেশকে তা জানিয়েও দিয়েছে দেশটির ইমিগ্রেশন ও পপুলেশন ডিপার্টমেন্ট। ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এর ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়নামারের ওপর অবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে বাংলাদেশের। এর আগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে কথা বললেন। গত বৃহস্পতিবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব সলিল শেঠি শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তিনি বলেন, দুই দেশের সরকারের উদ্যোগের পরও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।

এর আগে দুই দেশের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী, গত ২৩ জানুয়ারি থেকেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা ছিল মিয়ানমারের। সে অনুযায়ী, ওইদিন প্রথম দফায় ৭৫০ জন মুসলমান ও ৫০৮ জন হিন্দু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায় দেশটি। এমনকি এই চুক্তি বাস্তবায়নে এসব রোহিঙ্গাদের কিভাবে ফেরত পাঠানো হবে, তা চূড়ান্ত করে গত ১৬ জানুয়ারি আরেকটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। এই ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ অনুযায়ী, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সম্মত হওয়ার সময় থেকে দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয়। প্রতি সপ্তাহে দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। কিন্তু তখন মিয়ানমারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বাংলাদেশ সন্দেহ করে, কেবল বিশ্বকে দেখানোর জন্যই চুক্তির দুই মাস পূর্ণ হওয়ার দিন নামমাত্র রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরু করতে চায় মিয়ানমার।

এই ঘটনার ঠিক এক মাসের মাথায় মার্চে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের অনিচ্ছা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা বলে ১ মার্চ সকালে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ অংশের বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন ও গুলির ঘটনা ঘটায়। এতে সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। সংকট সমাধানে দুই দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠকও হয়। অথচ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির পোশাকে সেনা টহল অব্যাহত রাখে মিয়ানমার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি)। এমনকি তখন সীমান্তের জিরো পয়েন্টে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য মিয়ানমারের পক্ষ থেকে হুমকি ও চাপ দেওয়া হয়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের তালিকা নিয়ে মিয়ানমারের নতুন সিদ্ধান্ত নতুন করে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। ওই তালিকা অনুযায়ী, প্রথম দফায় বাংলাদেশ এক হাজার ৬৭৩টি পরিবারের আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে বলে। কিন্তু তালিকা দেওয়ার দেড় মাসেরও বেশি সময় পর গতকাল জানা যায়, দেশটি মাত্র ৫৫৬ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে। এ ব্যাপারে সে দেশের অভিবাসন ও জনসংখ্যা বিষয়ক দফতরের কর্মকর্তা মিন্ত কেইং একটি খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পাঠানো আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই করে তারা ৮০০ জনকে শরণার্থী হিসেবে অনুমোদন দিয়েছেন। এই ৮০০ জনের মধ্যে ৬৮৫ জন বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে মিয়ানমারে বসবাস করতেন বলে তারা জেনেছেন। এদের মধ্যে ১০ জন সন্ত্রাসী হওয়ায় ও ১২০ জনের কোনো ছবি বা বাড়ির নিবন্ধনের মতো কাগজপত্র দফতরের কাছে না থাকায় তাদের ফেরত নেবে না দেশটি।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সদিচ্ছার ব্যাপারে পুনরায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নানামুখী চাপের মুখে মিয়ানমার কখনো কখনো কিছুটা নমনীয় হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামান্য সামলাতে পারলেই আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। অর্থাৎ কোনোভাবেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না। এমন পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমারের ওপর নতুন করে কঠোর অবরোধ জারির ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চলতে পারে। নানা ধরনের চুক্তিও হতে পারে। কিন্তু এসব চুক্তি বাস্তবায়নে, অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে অবরোধ জারি করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। বাংলাদেশকে এখন তাদের মিত্রদের নিয়ে জোরেশোরে মুখ খুলতে হবে। কেননা মৌখিক আশ্বাস বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মতো বিষয়ের আলোকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসন যে সম্ভব নয়, বিশ্বকে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে বোঝাতে হবে। এ ব্যাপারে সবাইকে একমত হতে হবে।

গত ৩ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী রোহিঙ্গা-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণা পাঠ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীও অনুরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ প্রয়োজন। সেই অবরোধ কার্যকর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে।

এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর বলেন, মিয়ানমারের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের কথা-কাজের মিল নেই। সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে প্রথাগত কূটনীতির বাইরে নিয়ে আসতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি বন্ধুরাষ্ট্র সৌদি আরব, তুরস্ক বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা নিতে পারি। এ জন্য আমাদের সক্রিয়তা আরো বাড়াতে হবে।

অবশ্য রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগ এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে। সূত্রমতে, প্রথম তালিকা না মানায় রোহিঙ্গাদের আরেকটি তালিকা দেবে বাংলাদেশ। এবারের তালিকায় পাঁচ থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গার নাম থাকবে। গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গঠিত দ্বিতীয় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রস্তুতিমূলক সভায় রোহিঙ্গাদের তালিকা পাঠানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাচাইয়ের পর মিয়ানমারের কাছ থেকে প্রথম তালিকায় যে নামগুলো এসেছে, সেগুলো নিয়েও কাজ করা হবে। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের কাছে দ্বিতীয় তালিকা তৈরির কাজ হচ্ছে। একটি তালিকা দেওয়ার পাশাপাশি আরেকটি তালিকা করে তা দেওয়া হবে। এটি চলমান একটি প্রক্রিয়া।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। সে অনুযায়ী, কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা করছে।

এদিকে, চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে বাংলাদেশ নতুন করে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও শরণার্থী গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন। তারমতে, নতুন করে যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে- অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত। আঞ্চলিক দেশগুলোর রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। এ জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। দিনে দিনে রোহিঙ্গা ক্যাপে বিভিন্ন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে নারী ও শিশুর মৃত্যুর হার। মানবিক সমস্যার পাশাপাশি এই সংকট আরো অসংখ্যক সমস্যা তৈরি করছে। নারী, শিশু ও দুস্থ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নয়, আন্তর্জাতিক। ফলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে এটি মোকাবিলা করতে হবে।

এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তার অন্যতম হলো অর্থনৈতিক। এতে ওই অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়ছে, দিনমজুরের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা কক্সবাজার। রোহিঙ্গাদের কারণে পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

পাশাপাশি আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পে বসবাসরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ভূমিধস ও বন্যায় মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের হিসেবে অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গত আগস্টে মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে নতুন আসা সাত লাখসহ কক্সবাজারে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন প্রায় ১০ লাখ। পুরো জেলায় পাঁচ হাজার ৮০০ একর ভূমি এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। কৃষিজমি, পাহাড় বন উজাড় করে নির্মিত এই বসতি বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্যই এখন বিরাট ঝুঁকি তৈরি করেছে। অবশ্য এই ঝুঁকি থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা জানা গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist