প্রতীক ইজাজ

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

রাজনীতি কোন পথে

দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা ও কারান্তরীণকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতির জন্যই বেশি গুরুতপূর্ণ হয়ে উঠছে বিষয়টি। সামনে চলে আসছে নানা প্রশ্ন ও ভাবনা। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতি কোন পথে চলছেÑ এ প্রশ্ন যেমন আলোচিত হচ্ছে; তেমনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে এই রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায়- সে ভাবনাও পেয়ে বসেছে সবাইকে।

কেবল দেশের ভেতরই নয়, সাম্প্রতিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে আন্তর্জাতিক মহলেও। সবার একই প্রশ্নÑ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে তো? এই প্রশ্ন ঘিরে আলোচিত হচ্ছে নানা প্রসঙ্গ। খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, খালেদাকে বাদ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, আর গেলেও বা খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারলেও সার্বিক পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগÑ সে প্রসঙ্গ যেমন ঘুরেফিরে আসছে; তেমনি খালেদা জিয়ার মুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির চলমান ও নির্বাচনী রাজনীতি কেমন হবেÑ সে দিকেও তাকিয়ে সবাই।

খালেদা জিয়ার সাজা ও কারাগারে যাওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে কোনো সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি। খালেদার মুক্তির দাবিতে বিএনপি যেমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছে, তেমনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারও সহনীয় আচরণ করছে। কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের উসকানি বা বিশৃঙ্খল রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়নি। এমনকি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে দুই দলেরই সদিচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বর্তমান রাজনীতিকে দুই দলের ‘সতর্ক’ ও ‘কৌশলী’ রাজনীতি বলে মনে করছেন। তাদের মতে, চলমান রাজনীতি দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিকে দেখা যাবে না। কারণ দুই দল এখন দুই ধরনের রাজনীতিতে রয়েছে। রাজনীতির খেলায় জিততে মরিয়া দুই দল পরিস্থিতি বুঝে কৌশল বদলাচ্ছে। রাজনীতিতে স্থিরতা নেই। খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি নাÑ সে বিষয়টির সমাধান এলে তবেই রাজনীতি এক ধরনের আকার পাবে। এটার ওপর নির্ভর করবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি।

বিশেষ করে নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া মুক্ত হলে রাজনীতিতে এক ধরনের হিসেব দেখা দেবে। আবার শেষ পর্যন্ত কারাগার থেকে বেরুতে না পারলে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে বা মুক্ত হতে সময় নিলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সরকারের জন্য সহজ হবে। এমনকি নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির দ্বিধান্বিত রাজনীতির ফসল যাবে ক্ষমতাসীনদের ঘরে। অন্যদিকে, মুক্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে দরকষাকষি এবং নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়াসহ সব ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া বিএনপির জন্য খুব সহজ হবে। একইভাবে তার অনুপস্থিতিতে প্রতিটি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দলটির জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে।

তবে খালেদা জিয়ার সাজা এবং রায় পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রায়ের আগে ও পরে এবং রায়ের দিন পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী পক্ষ দায়িত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। রায় কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, রায়ের আগে ও পরে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আচরণ লক্ষ করা গেছে। যদিও বিএনপি রায়কে ‘প্রতিহিংসার’ উল্লেখ করে রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এ নিয়ে আপত্তিকর কোনো মন্তব্য করেননি। রায়ে সরকারের কোনো হাত নেই বলে আগের অবস্থানেই রয়েছেন।

এমনকি বিশ্লেষকরা এ কথাও বলছেন, খালেদা জিয়ার সাজার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সুযোগ নেই। কারণ বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, নির্বাচন সামনে রেখেই তারা সতর্ক ও সমঝোতার কর্মসূচি দিয়েছে। তবে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে সে ক্ষেত্রে দল কি করবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কি হবেÑ সেটি নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনকে সরকার কিভাবে দেখে, তার ওপর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া জামিনে বেরিয়ে আসবেন। কিছুদিন সময় লাগতে পারে। তাই খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি নিয়ে যেসব সমীকরণ মেলানো হচ্ছে তা সফল হওয়ার নয়। কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বলে দিচ্ছে খালেদা জিয়াকে জেলে রাখা হলে নির্বাচনে বিএনপির আসন বেড়ে যাবে। সরকারও সেটা বুঝতে পেরেছে। ফলে সরকার তাকে আর আটকে রাখবে না বা বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেবে না। তার মানে রাজনীতি যেমনই হোক, সবার লক্ষ্যই নির্বাচন।

তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের মতে, খালেদা জিয়া সাজা নিয়ে কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে অতীতে বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের জেলে যাওয়া বা ইস্যুর কোনো মিল নেই। এটি জনস্বার্থের ইস্যু নয়। বিএনপি চাইলেও এই ইস্যুকে সার্বিক রাজনীতিতে কাজে লাগাতে পারবে না। খালেদা জিয়ার সাজায় সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। খালেদা জিয়ার সাজার ঘটনাকে আইনগতভাবেই মোকাবেলা করতে হবে বিএনপিকে। কারণ এর আগেও জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি করে বিএনপির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জনগণ তাদের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করেছে।

এই বিশ্লেষক এমনও বলেন, বিএনপির মধ্যে সংকট ঘনীভ‚ত হবে। তারেক রহমান কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দÐিত আসামি। তার নেতৃত্বে এখন দল পরিচালিত হবে। এতে দল দুর্বল হওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করবে। দলের মধ্যে সংকট দেখা দেবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে দল ভাঙা-গড়ার বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিরোধ জোরালে হবে। কারণ তারেক রহমানকে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থি নেতারা মেনে নিতে চাইবে না।

বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে নির্বাচনী মাঠ থাকবে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। আর ওই ঘটনার প্রভাব অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও পড়বে। তারা তখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে না থেকে সরকারের দিকেই ঝুঁকবে, অর্থাৎ নির্বাচনে যাবে। কারণ খালেদা জিয়া নির্বাচনের মাঠে না থাকলে ওইসব দলের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট দেখা দেবে। তাদের কাছে তখন চাপ ও প্রলোভন আসবে। এমন পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির তুলনায় বেশিসংখ্যক দলের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে বিএনপির নির্বাচন বর্জনও তখন কার্যকর ফল বয়ে আনবে না।

তবে চলমান রাজনীতিতে দুই দল নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে বলে দলের নীতি নির্ধারণী নেতারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে আগে থেকেই মাঠে থাকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় এবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছে খালেদা জিয়ার রায়। এখন রায় নিয়ে কথা না বলার নির্দেশ থাকলেও প্রচারণায় খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের দুর্নীতির বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরা হবে। এর জন্য ইতোমধ্যেই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে নির্দেশ গেছে। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিএনপির আইনি ব্যস্ততাকেও নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগাতে চায় দলটি। কে নির্বাচনে এলো কি এলো নাÑ এমনটি ভেবে সময় নষ্ট করতে চান না ক্ষমতাসীনরা। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়টি মাথায় রেখে তাই নতুন করে মাঠে সরব হবে দলটি।

একইভাবে একইভাবে ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে বিএনপিও। প্রচারণায় ভোটারদের সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি জানানোই হবে দলের মূল লক্ষ্য। ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও সমন্বয় করতে কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে নির্দেশ গেছে। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মামলার রায়ে সরকারের হাত আছেÑ সে তথ্যও প্রচার করতে চান তারা। খালেদা জিয়ার মুক্তিতে আন্দোলন ও নির্বাচনী প্রস্তুতিÑ দুটোই একসঙ্গে চালাবে দল। নিজেদের আরো শক্তিশালী করতে নতুন জোট গঠনের চিন্তাভাবনাও চলছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখনই আন্দোলনের একটি রূপরেখা দাঁড় করাতে চায় বিএনপি।

এ ব্যাপারে গতকালও সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনের আগে সংলাপের কোনো প্রয়োজন হবে না। আমরা জানি, বিএনপি নির্বাচনে আসবেই। কারণ, বিএনপি নেতারাই তো বলছেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ায় বিএনপি আরো শক্তিশালী হবে। তিনি এমনও মন্তব্য করেন, ‘আমরা আশা করি, সেই শক্তিশালী বিএনপিকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ নির্বাচন হবে।’ অন্যদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না এমন অভিপ্রায় থেকে সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হবেÑ এটি যে সরকারের হিসাব-নিকাশ তা কেবল আমরা নই, দেশের জনগণও বোঝে। তবে তাদের ওই অভিপ্রায় বা ইচ্ছা পূরণ হবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। তিনি এমনও বলেন, রাজনীতির হিসাব বিএনপিরও আছে। তাদের হিসাবে বা ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না। বিএনপি তার হিসাবেই এগোবে; খালেদা জিয়ার পরামর্শেই সবকিছু হবে। চাপ দিয়ে কিছু আদায় করা সহজ নয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist