রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

অদৃশ্য বোতাম ও মধ্যপ্রাচ্য সংকট

সমুদ্রতীরের উত্তপ্ত বালুর ওপর পড়ে থাকা শিশু আইলানের নিথর দেহ এবং সিরিয়ার ভবনধসের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রক্তাক্ত শিশু ওমরানের ক্ষতবিক্ষত দেহ বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশের পর বিশ্ববিবেককে আন্দোলিত করেছিল ব্যাপকভাবে। খুবই নিষ্ঠুর মানবসন্তান ছাড়া বোধ করি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাইকে কাঁদিয়েছিল ঘটনা দুটি। বিশ্ব সমবেদনা তখন উপচে পড়ে বিশ্ববিবেকের সাধারণ বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি, সেদিকে কারো দৃষ্টি পড়েনি আইলান ও ওমরানের মতো। আর কোনো শিশুর জীবনে যেন তেমন করুণ পরিণতি নেমে না আসে সে সতর্কতা বা সজাগ হয়নি বিশ্ব। বিশ্বসমাজ কেবল নিষ্ঠুর নীরবতাই দেখিয়ে আসছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিবিসি ও এএফপি প্রচারিত দুটি খবর সিরিয়াসহ আরব জাহানের সমস্যা যে অচিরে সমাধানের মুখ দেখবে না, তা জানান দিচ্ছে। সিরিয়াবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্তেফান দি মিস্তুরা জেনেভায় জাতিসংঘ আয়োজিত সিরিয়াবিষয়ক শান্তি আলোচনা শুরুর আগে মন্তব্য করেছেন, এসবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কোথায়? আমি বলতে পারছি না, কারণ আমার জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাবের পর হতেই জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রদূত নেই। এটা অকল্পনীয় যে, স্নায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ে একক পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে কোনো রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেবে না। কয়েক মাস আগেও জাতিসংঘের কোনো দফতরে এমন মন্তব্য অকল্পনীয় ছিল। সিরিয়া ও ইরানের পারমাণবিক ইস্যু, আইএস, ইরাক, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির পদভারে কূটনৈতিক অঙ্গন নিয়মিত ক্লান্ত হয়ে উঠত।

কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদদের অবর্তমানে সেখানে আশা-শূন্যতা বিরাজ করতে শুরু করেছে। দীর্ঘ ৪৫ বছরের ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একের পর এক আলোচনা, সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কতগুলো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ইসরায়েল-মিসর ও ইসরায়েল-জর্দান আলোচনার মাধ্যমে পৃথক শান্তি চুক্তিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ আজও শেষ হয়নি। ফলে এ দুটি পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সম্প্রতি শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই সুযোগে স্পষ্ট করা দরকার মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহাসিক আলোচনা, পরিকল্পনা ও উদ্যোগ কেন বারবার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সৌদি আরব ও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা হিসেবে পরস্পর ব্লেম গেম খেলছে। আসলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা কোথায়? মধ্যপ্রাচ্যে চলছে ভূরাজনীতিতে মোড়ল হওয়া আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। সম্প্রতি যুবরাজ এমবিএস সৌদি রাজপরিবারের প্রিন্সদের ঘাড়ে দুর্নীতির তকমা লাগিয়ে যে গণগ্রেফতার চালিয়েছেনÑযা এখনও চলমান, তার একমাত্র কারণ যুবরাজের সিংহাসন নিশ্চিত ও ক্ষমতাকে দৃঢ় করার প্রয়াস। ২০১১ সালে সিরিয়ায়, ২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়ানোর কারণ হিসেবে যতটা শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, তার চেয়ে বড় কথা হলো ইরানের প্রভাব ঠেকানো। কিন্তু রাশিয়ার সোচিতে ২২ নভেম্বর পুতিন, রুহানি ও এরদোগানের সম্মিলিত প্রয়াসে সিরিয়ায় বিরোধী ও সরকারি দলকে নিয়ে সিরিয়ান পিপলস কংগ্রেস সরকার গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা থেকেই স্পষ্ট।

সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাতে রক্তের হোলিখেলা ছাড়া কোনো শান্তি প্রতিষ্ঠার আলামত মেলেনি। সিরিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব ব্যর্থ রক্ত ঝরানো ছাড়া কোনো সমাধান দিতে পারেনি। এখানে ওয়াশিংটন-রিয়াদ কৌশলগতভাবে পরাজিত হয়েছে। প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাশার মিত্র তেহরান ও মস্কো নিয়েছে, আর তাতে বাশারবিরোধী হয়েও তুরস্ক নিজেকে শামিল করেছে। এদিকে সৌদি আরব কেন সিরিয়া ও ইয়েমেনে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরাল? লেবানন নিয়ে কেন এত ড্রামা চলছে? এর পেছনে মূল কারণ ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ ভীতি। কারণ সৌদিতে চলছে রাজতন্ত্রের শাসন আর হিজবুল্লাহ রাজতন্ত্রের বিরোধী, যা রিয়াদের বড় মাথাব্যথার কারণ। অন্যদিকে রিয়াদমিত্র তেল আবিবের গলার কাঁটা হলো হামাস ও হিজবুল্লাহ, যার জন্য ইসরায়েল গাজা উপত্যকা গিলতে পারছে না। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন হামাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে শিয়া হিজবুল্লাহর। হামাস ও হিজবুল্লাহ উভয়েই আবার মিসরের ইসলামী আন্দোলনকারী দল ব্রাদারহুডের সমর্থক। মুসলিম ব্রাদারহুডের আরেক সমর্থনকারী দল তুরস্কের এরদোগান সরকারের একে পার্টি, যারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। আবার সবক’টি দল একই সঙ্গে রাজতন্ত্র এবং ইসরায়েলবিরোধী। তাই একদিকে ইসরায়েল ভয়ে আছে তার ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে, আর সৌদি যুবরাজ বিন সালমান (এমবিএস) আছেন তার আগামী দিনের রাজতন্ত্রী সিংহাসন নিয়ে।

আরব দেশগুলোর নেতৃত্বদানকারী সৌদি আরব ইসরায়েলের মদদে মধ্যপ্রাচ্যে প্রত্যক্ষভাবে ইরানকে ঠেকাতে চাচ্ছে, আর পরোক্ষ ভয়ে আছে তুরস্কের অভ্যুত্থান নিয়ে। কারণ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র। ন্যাটোর ৫নং ধারা অনুযায়ী কোনো সদস্যরাষ্ট্র আক্রান্ত হলে অন্য রাষ্ট্র তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাই সৌদি আরব সরাসরি তুরস্ককে দমনের কথা বলতে পারছে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্য রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না। ৫ জুন কাতারের ওপর অবরোধের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটা হলো তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু সৌদি আরব এখানেও ইরান-তুরস্কের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। অবরোধের প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল, কাতারকে হয়তো ইয়েমেনের মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে। কিন্তু তুরস্ক তার কাতার সেনাঘাঁটিতে আরো বাড়তি সেনা মোতায়ন করে, আর ইরানের সঙ্গে মিলে খাদ্য সহায়তা দেয়, ফলে সৌদি অবরোধ কাতারের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। সৌদি জোট যে অজুহাত ইরানকে নিয়ে পেশ করছে তার কোনো বাস্তবতা নেই। ইরান বিরোধিতার বড় কারণ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল থেকে ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের সফল প্রভাব বিস্তার। ইরান শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানে সৌদিকে টপকে শীর্ষে অবস্থান করছে। তাই ইরানের প্রভাব বাড়তে থাকলে একসময় সে প্রভাবে রাজতন্ত্রের সিংহাসন হয়তো থাকবে না, এ প্রভাব রাজতন্ত্রী অন্য আরব দেশগুলোর ওপর যে পড়বে না, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সৌদি আরব ইরানকে ঠেকাতে আরব জোটভুক্ত দেশগুলো নিয়ে কাজ করছে।

ইরানের ওপর সন্ত্রাসবাদে মদদের গুজব এনে ইরানকে নানা কৌশলে দমনের চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই। আর এ দমনে ইসরায়েল খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করছে সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশকে। এত রক্তপাতের পরও রিয়াদ জয়ী হতে পারছে না। এদিকে হাইছিরা ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণ ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। সবদিক থেকে পরাজয় আর প্রভাব খর্ব হতে দেখে খ্যাপাটে যুবরাজ কখন যে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হারিরি পদত্যাগের আগে হাইছিরা সৌদির বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেছে রিয়াদ। আর এ ক্ষেপণাস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে ইরানকে দায়ী করেছে রিয়াদ। এভাবে উত্তেজনা চলতে থাকলে যে কোনো সময় হামলা বা যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যা চাইছেন। ইরান-সৌদি যুদ্ধ শুরু হলে মস্কো-আঙ্কারা ছাড়া আর কোনো দেশকে পাশে পাবে না। অন্যদিকে সৌদি আরবের পাশে জোরালো অবস্থান নেবে তেল আবিব ও ওয়াশিংটন, যা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাকাশে নতুন ধোঁয়াটে পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ইরান-সৌদি যুদ্ধের পুরো ফায়দা লুটবে ইসরায়েল। দীর্ঘদিনের শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব প্রশমিত হবে না, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব চরমে উঠবে। সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, বাহরাইনসহ শিয়া অধ্যুষিত দেশগুলোয় গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত মুসলিম দেশগুলোয় নিভন্তপ্রায় অগ্নিগর্ভে নতুন করে ঘি ঢেলে আগুন ধরানো হবে।

আর তাই আজ আরব বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাস সিরিয়ায় প্রবিষ্ট হয়েছে চৈত্রের দাবদাহে, চৈতি লু হাওয়া ওলটপালট করে দিচ্ছে সিরিয়ার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতিকে। প্রশ্নÑ কেন এমন হলো? কী হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতে? কী আছে সিরিয়ার নির্যাতিত জনগণের ভাগ্যে? কী আছে শরণার্থীদের কপালে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে হুগভেল্ট, ফ্রাঙ্ক, ওয়ালার স্টেইন, কার্ডোসো ফ্যালেটটো প্রমুখ ছকবিন্যাস তাত্ত্বিকগণের তত্ত্ব, বিশ্লেষণ ও দর্শনের মধ্যে। কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজন ওই রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য, যারা প্রত্যক্ষভাবে বৈশ্বিক শোষণ-প্রক্রিয়ার শিকার। সিরিয়ার ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমস্যাটিকে ব্যাক গিয়ারে ছুড়ে দিচ্ছে। আবার শান্তি প্রচেষ্টার মোড়কে রাশিয়া তার আরব আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উন্মত্ত। আরবরা এ ব্যাপারে শতধাবিভক্ত। বিশ্বশক্তিগুলোর সমীকরণ বোধগম্য। কিন্তু আরবরা কেন বিভক্ত? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারও কেউ নেই। তাই, সমস্যা সমাধানে প্রকৃতির হস্তক্ষেপ হয়তো অপেক্ষা করছে।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist