পঞ্চানন মল্লিক

  ১৮ নভেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

ডিজিটাল ভাবনায় এনালগ...

মুঠোফোনে নিমগ্ন সন্তানদের উদ্দেশে আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়-‘খাও দাও রাস্তা মাপ, রাইতে দিনে মোবাইল চাপ।’ এখানে মোবাইল চাপার কথা বলতে মুঠোফোনে ডাটা ব্যবহার করে নেট বা অনলাইনে ঢুকে গেম খেলা বা ফেসবুকে পোস্ট, লাইক, কমেন্ট করাকেই বোঝানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সন্তানরা এই যে রাত-দিন মুঠোফোন চাপছে, নেটে ঢুকে সময় পার করছে, এর ফল ভালো না মন্দ হয়ে ভবিষ্যতে আমাদের ঘাড়ে চাপবে? অর্থাৎ এর প্রভাব আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জীবনে শুভ না অশুভ কিছু বয়ে আনবে? এই নিয়ে রাস্তায়, হোটেলে, পার্কে অথবা যেকোনো আড্ডায় ব্যাপক গবেষণা চলছে। যদিও ফল শূন্যের নিচে। কেউ কেউ এটিকে নেগেটিভ সেন্সে দেখছেন, কেউ বলছেন ভালো। বিশেষ করে মান্ধাতা আমলের ম্যানুয়েল সিস্টেমের পরিবর্তে এক স্বচ্ছ, দ্রুতগামী, আধুনিক যোগাযোগ ও বিশ্ব বিচরণ ব্যবস্থার ইঙ্গিত যে এর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আগে লোকজনকে বলতে শোনা যেত, ‘নেই কাজ তো খই ভাজ।’ কিন্তু বর্তমানে মানুষের কর্মজীবনের প্রেক্ষাপট অনেকটা পালটে গেছে। আসলে খই ভাজার মতো সময়ও এখন কারো হাতে আছে বলে মনে হয় না। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মব্যস্ত। আর এই ব্যস্ত কাজে মানুষকে আশ্চর্য রকম সহায়তা করছে প্রযুক্তি। অবশ্য পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিসেরই ভালো এবং মন্দ এই দুটি দিকই রয়েছে। ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ের ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ এই প্রশ্নটির উত্তর আজও মনে হয় আমরা কেউ সঠিক ভাবে নিরূপণ করতে পারব না। যেখানে আলো আছে সেখানে অন্ধকার চিরন্তন সঙ্গী। সেটা আমরা সবাই জানি। তবে সব কিছুর মূল হচ্ছে কোনো একটি বিষয়কে আমরা কিভাবে গ্রহণ করছি বা মেনে চলছি বা অনুসরণ করছি। বিশেষ করে বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে তথ্য-প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল আমাদের হতে হবে-এটাই স্বাভাবিক। তবে তা যেন অনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবান্বিত না হয়, সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে আমাদের শিশুরা যেন এর খারাপ প্রভাবে না পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যেন অপরাধ প্রবণতায় নিজেদের জড়িয়ে না ফেলে। আবার অত্যধিক ব্যবহারে মেতে যেন নিজেদের পড়াশোনা বা কাজের ক্ষতি না করে। মুঠোফোনে পর্নোগ্রাফি বন্ধ করাই এখন একটি অন্যতম কাজ। অবশ্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু পর্নোসাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এটি আমাদের জন্য একটি আশার খবর। আসলে আমাদের শিশুরা যাতে পর্নোসাইটে ঢুকতে না পারে তার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সঠিক প্রতিপালনও জরুরি। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ যেন কাউকে হেয় প্রতিপন্ন, ক্ষতিগ্রস্ত, প্রতারিত, টিজিং ইত্যাদি করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখাটা জরুরি।

বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি চালু বা বাস্তবায়নের উদ্যোগ মাত্র কয়েক বছরের, তবে খুব দ্রুতগতিতে তা এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে দেশে ব্যাপক সাড়াও ফেলেছে। আমাদের জরিনা, রহিমা, সখিনারাও এখন ইন্টানেটের ব্যবহার জানে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সময় উপযোগী স্লোগানে পরিণত হয়ে দেশে বেশ জনপ্রিয়তা লাভসহ জনমনে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। সরকারও ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে একেবারে নি¤œ পর্যায়ের অফিস আদালতগুলোতে কম্পিউটার, ল্যাপ্টপ, ট্যাব, প্রিন্টার, স্ক্যানিং মেশিন ইত্যাদি বিতরণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইসিটিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ফ্রি ওয়াইফাই জোন চালুকরণ, শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামে স্বতন্ত্র বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরণ ইত্যাদি। ইতোমধ্যে জাতীয় তথ্যভান্ডারের সব তথ্য সংরক্ষণের জন্য যশোরে ‘ইনফো সরকার’ প্রকল্পের আওতায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার’। এছাড়া দেশে ২৮টি আইসিটি পার্ক নির্মিত হচ্ছে। ১৮ হাজার ১৩০টি সরকারি দফতরে ফাইবার অপটিকের ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলা ও ৪৮৭টি উপজেলায়। ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে দেশের ৮০০ সরকারি অফিসে। ‘ইনফো সরকার-৩’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ২ হাজার ৬০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক কেবল পৌঁছে যাবে। এর ফলে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে মানুষ অধিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারবে। চাকরি ক্ষেত্রে আজকাল ই-নথি, ই-মিউটেশন ইত্যাদির কথা বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। এগুলো চালু হলে যেমন অফিসের কাজে ব্যাপক গতিশীলতা সৃষ্টি হবে, তেমনি অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতারও সুযোগ সৃষ্টি হবে। লোকজন ঘরে বসে অনেক বিষয়ে সেবা নিতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে নেট বিড়ম্বনা ও অধিক নেট মূল্য। বিশেষ করে ইন্টারনেটের মূল্য একটি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে না পারলে তা সাধারণের সহজে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসবে না। বিভিন্ন মুঠোফোন কোম্পানিগুলোকেই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। মুঠোফোনের কল রেট যেমন একটি সাশ্রয়ী পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভবপর হয়েছে-বর্তমানে কল রেটে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় নিম্নতম স্থানে অবস্থান করছে; ইন্টারনেট ব্যয়ও তেমনি কমিয়ে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় বহুল প্রতীক্ষিত দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন উদ্বোধন করেছেন। এটি উন্নত ও দ্রুততর ইন্টারনেট সংযোগ পেতে জনগণের জন্য বেশ সহায়ক হবে। দেশকে ডিজিটালাইজেশনের পথে এগিয়ে নিতে আমাদের সবাইকেই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। নেতিবাচক মনোভাবে না গিয়ে কী করে দেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে সে লক্ষ্য নিয়ে আমাদের এগোতে হবে। ৩০ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশটি আমাদের সবার। তাই দেশের অগ্রগতি, উন্নতির কথা সবাইকেই ভাবতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে যখন প্রযুক্তির ওপর ভর করে বিশ্বের অন্য সব দেশ তরতর বেগে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা নিজেরাই যদি এগুলো নিয়ে পরস্পর বিরোধাত্মক মন্তব্যে লিপ্ত হই, তাহলে দেশ যেমন বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না, তেমনি অগ্রগতি ও উন্নয়ন থেকে আমরা থাকব পিছিয়ে। তাই সবাইকে সমন্বিতভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে উদ্যোগী হতে হবে। একটি বিশ্বমানে আমাদের দেশের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনাকে পৌঁছে দিতে হবে। সর্বোপরি বিশ্বায়নের যুগে দ্রুত কর্ম সম্পাদনের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের যে কোনো বিকল্প নেই, এটা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান এখনো আমাদের সবার সমান আয়ত্তে নেই। এ ব্যাপারে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। আমাদের আশপাশে যারা আছেন তাদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজন এ কারণে যে, মূলত আমরা এনালগি। ডিজিটাল খাবার যেকোনো সময় পেটপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এখানেই আমাদের সাবধান হতে হবে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist