হাসান সাইদুল

  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

ভাষা

ইংরেজির দাপটে বাংলার অপব্যবহার

১.

“ইয়েস ওয়েলকাম অ্যাগেইন... আমি নিতুল ছিলাম এতক্ষণ। আজ এ পর্যন্তই। টুমরো আবারো আসব এক্সাইটিং সব অফার নিয়ে। শুনতে থাকুন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। টা টা, বাই বাই, গুড অ্যাট নাইট।”Ñ ঠিক এভাবেই কথাগুলো বললেন আর জে নিতুল। গত (সপ্তাহ) সোমবার রাত ৮টা ১৮ মিনিটে বেতার স্টেশন রেডিও নেক্সট ৯৩.২ এফএমে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি অনুষ্ঠানের সম্প্রচার এটি। অনুষ্ঠান চলাকালে আরজে নিতুলের ছবিসহ রেডিও নেক্সটের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে একটি পোস্ট করা হয়। তাতে লেখা হয়Ñ ‘মেইড ইন বাংলাদেশ ইজ অন উইথ আর জে নিতুল। সো স্টে কানেক্টেড।’ ওই পোস্টে একটি মন্তব্য ছিলÑ ‘আপু, আমি তোমার নিউ ফ্রেন্ড।’ এই হলো একটি এফএম রেডিও স্টেশনের অনুষ্ঠানের কথামালা। শুধু রেডিও নেক্সট নয়, প্রায় সব এফএম রেডিও স্টেশনের অনুষ্ঠানের ধরনই প্রায় অভিন্ন। অথচ এই অনুষ্ঠানটি বাংলা ভাষায় সুন্দর শব্দে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা যেত। তাহলে শ্রোতারাও ফেসবুকে সুন্দর বাংলায় মন্তব্য করতেন।

‘স্মাইল ইজ দ্য অনলি ওয়ান থিং ক্যান বাই এভরিথিং উইদাউট অ্যান কস্ট’Ñ ইংরেজি শব্দগুলোকে বাংলায় লিখে এভাবেই ফেসবুকে দিয়েছেন মিথিলা (অর্ধনাম) ‘কাইলকা পরীক্ষা, কিছুই পড়িনাইক্যা। হে আল্লাহ, আমাকে তুইল্যা নাও, নয়তো উপড়ে থেইক্যা দড়ি ফেলাও, আমি উইঠ্যা যাই।’ পরীক্ষার আগের রাতে এই ছিল রনির (ছদ্মনাম) স্ট্যাটাস।

কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’, ‘স্ট্যাটাস’Ñ এসব শব্দের এত বিপুল ব্যবহার ছিল না। আর এখন এগুলো হরহামেশাই উচ্চারিত হচ্ছে। যেন নিজস্ব শব্দ, একেবারে বাংলা ভাষার মতোই ব্যবহার হচ্ছে। এ তো গেল ইংরেজি শব্দ। বাংলা শব্দেরও বিচিত্র ব্যবহার রয়েছে, যা মিথিলা কিংবা আবিরের স্ট্যাটাসেও কিছু আছে।

২.

শান্তিনগর মোড় থেকে বেইলি রোডে ঢুকতে বাঁয়ে বড় বড় হরফে সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নাম লেখা দেখে বাংলাপ্রেমীর মন জুড়িয়ে যাবে। কিন্তু তারপর থেকে সড়কের ডানে ও বাঁয়ে হঠাৎ বাংলা সাইনবোর্ডের দেখা মেলে। সড়কের ডানপাশে একটি বড় ভবনে দেখা যায়, গোল্ডেন ফুড, ক্যালিফোর্নিয়া ফ্রাইড চিকেন, রেড কোর্ট, হট কেক, ড্যাজলিং বিউটি পার্লার, ওয়েসিস রেস্টুরেন্ট, জেন্টলম্যান সেলুন, শর্মা হাউস, হেলভেটিয়া ফাস্ট ফুড এবং বেইলি গার্ডেন রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড। এসব সাইনবোর্ডের প্রায় সবই ইংরেজিতে লেখা।

ওই ভবন রেখে আরেকটু সামনে এগোলে একটি বড় বিপণিবিতানের নাম প্যাঁচানো ইংরেজি হরফে লেখা ‘নাভানা বেইলি স্টার’। বিপণিবিতানের বাইরে দাঁড়ালে দেখা যায়, তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় লেখা। এগুলো হচ্ছে ‘সাদা কালো’, ‘চৈতি’ ও ‘স্বপ্ন’। বাকি সব নামই দাঁতভাঙা ইংরেজিতে লেখা। এগুলো হচ্ছে বুমারস ক্যাফে, মেনজ ক্লাব, অ্যারিয়ানস, স্টারডাস্ট, ওয়েস্টউড, স্টার ওয়ার্ল্ড, হ্যালো মাম ইত্যাদি।

গুলশান-২ নম্বর গোল চক্কর এলাকার ঠিক পশ্চিমপাশেই তাহের টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্স, যার ২৪টি সাইনবোর্ডের মধ্যে ১৮টিই ইংরেজিতে লেখা। গোল চক্করের দক্ষিণপাশ ঘেঁষে (খুব কাছাকাছি) উত্তরের নগর ভবন, যার পাশেই রব সুপার মার্কেট। সেখানে মোট ১৯টি সাইনবোর্ড এবং তিনটি ব্যানার রয়েছে। এর মধ্যে বাংলায় সাইনবোর্ড মাত্র একটি, দুটি ব্যানার। চারটিতে আছে বাংলা ও ইংরেজি মেশানো। অন্যসব সাইনবোর্ডই ইংরেজিতে।

মোহাম্মদপুরের রিং রোডে অন্তত ডজনখানেক ভবনের ৪৫টি সাইনবোর্ডের মধ্যে ৬টি বাংলায়। বাকিগুলোর মধ্যে দুটিতে বাংলা ও ইংরেজি একসঙ্গে লেখা। আর অন্যসব সাইনবোর্ডই ইংরেজিতে।

তবে পুরান ঢাকার জনসন রোডের চিত্র ভিন্নÑ জেলা পরিষদ কার্যালয়ের আশপাশে ২০টি সাইনবোর্ডের মধ্যে মাত্র তিনটি ইংরেজিতে লেখা।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটে থাকা ৯১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবগুলোর নামই বাংলায়।

৩.

‘টু-লেট’, ‘রেস্টুরেন্ট’, ‘মেডিসিন হাউস’Ñ রাস্তায় বের হলে খুব সহজেই চোখে পড়ে এসব শব্দ। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গ্রন্থাগারগুলোর বেশিরভাগেই বড় বড় অক্ষরে রোমান হরফে (ইংরেজি) লেখা সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড-নামফলক। এছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, দোকানপাট, শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। এসব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলার নিজস্ব কোনো শব্দভা-ার নেই। শুধু বর্ণমালাকে ব্যবহার করে ইংরেজি শব্দের মাঝেই আমাদের বসবাস।

টেলিভিশনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো দেখলে চাক্ষুষ প্রমাণিত হবে, দেশের কতিপয় গণমাধ্যমকর্মী বাংলা ভাষাকে কিভাবে বিকৃত করছে, কিভাবে তারা বিদেশি শব্দের সঙ্গে বাংলা অথবা বিদেশি শব্দ আর বাংলা শব্দকে মিশিয়ে সংযোজন-বিয়োজন করছে।

ভাষা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাতৃভাষায় নিজস্ব শব্দের সংযোজন কম। নিজেদের শব্দ বাদ দিয়ে প্রতিনিয়তই বিদেশি শব্দের প্রচলন হচ্ছে। আর এর পেছনে কারণ হিসেবে নিজস্ব ভাষার প্রতি অনাগ্রহকেই দায়ী করছেন তারা। ‘পিলসুজ’ বা ‘ছবিঘর’ শব্দ দুটিকে এখন কী নামে ডাকা হয়, তা জানতে চাওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন ছাত্র বলেন, ‘আই ডোন্ট নো। তবে ছবিঘর মেই বি স্টুডিও বাট পিলসুজ শব্দটি কখনো শুনিনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করতে গিয়ে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন। আবার অনেকে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার করার কারণে দুই ভাষার সংমিশ্রণ ঘটায়। বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ। আমাদের এত চমৎকার কিছু শব্দ আছে, যা ব্যবহার না থাকায় হারিয়ে গেছে। তাছাড়া আমরা আমাদের ভাষা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। এতে নিজেদের তৈরি শব্দ হারিয়ে গিয়ে বিদেশি হরেক রকম শব্দের প্রচলন হচ্ছে।’

তবে ভাষার পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তার মতে, মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষ নিজ প্রয়োজনে ভাষার গতি সময়ে সময়ে বদলে নেয়। হাজার বছরের পুরনো বাংলা ভাষায়ও এমন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। আজকের দিনে প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর গণমাধ্যমের প্রভাবে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ। তবে অনেক শব্দই ঝরে যাবে, আবার কিছু টিকে থাকবে। গ্রহণ কিংবা বর্জন, যা-ই হোক না কেন, এটাই সত্য যে, ভাষার এই পরিবর্তন চলবে। আর অভিধানের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত শব্দকেই প্রধান্য দেওয়া হয়। তবে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় মিশ্রিত কথা আমাদের শব্দভা-ারকে হালকা করে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ সংবিধানের সবচেয়ে ছোট অনুচ্ছেদটি হচ্ছে অনুচ্ছেদ ৩। তিনটি মাত্র শব্দের সমন্বয়ে এই অনুচ্ছেদটি গঠিতÑ ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে কী হবে, আমাদের উচ্চ আদালতে তো একচ্ছত্র শাসন চলছে ইংরেজিরই। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।’

১৯৭১ সালে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেনÑ ‘বাংলা হবে দেশের সরকারি ভাষা।’

এরপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ দশক। এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য চলছে যুদ্ধ।

জানা গেছে, বাংলা ভাষার প্রচলন আইন হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। এরপর ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা নিশ্চিত করতে ৯টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রিসভা। ওই বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১০ সচিবের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়Ñ ‘রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বার বার সকল স্তরে বাংলা প্রচলনের আদেশ দিলেও আংশিক কার্যকরী হইয়াছে, কোথাও হয়নি।’

এরপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিচারপতি কাজী ইবাদুল হক এবং বিচারপতি মো. হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ফৌজদারি মামলায় বাংলায় রায় দেওয়ার পর তা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো উচ্চ আদালতে ইংরেজিতে রায় দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট এবং বিভিন্ন দপ্তরের নামফলকে বাংলা ব্যবহার করতে বলেন।

৪.

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুসারে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৯ হাজার। এর মধ্যে চালু রয়েছে ১৭ থেকে ১৮ লাখ। হাইকোর্টের ওই আদেশের আগেই ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে চালু করা হয় রেট্রো-রিফ্লেক্টিং নম্বরপ্লেট তথা ডিজিটাল নম্বরপ্লেট। বিআরটিএর আইন অনুযায়ী প্রতিটি গাড়িতে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট লাগানো বাধ্যতামূলক। আর বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা ডিজিটাল নম্বরপ্লেট বাংলায়ই। জানা গেছে, এখনো পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ গাড়িতে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট লাগানো হয়েছে। বাকি ৫-৬ লাখ গাড়ির ব্যবহারকারীর মধ্যে, বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরা ইংরেজি নম্বরপ্লেট ব্যবহার করে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়ার কারণ হিসেবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং উচ্চ আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা বাংলা ব্যবহার করে না, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist