মহিমা ইসলাম রিমি

  ২০ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তমত

তরুণদের আদর্শের প্রতীক ‘রুমী’

শাফী ইমাম রুমী। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বীরবিক্রম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল ‘একাত্তরের দিনগুলি’ দিনলিপির শিরদাঁড়া ও জাহানারা ইমাম ও শরীফ ইমামের বড় সন্তান। ১৯৭১ সালে রুমী ছিলেন ২০ বছরের তরুণ। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রুমী সেক্টর-২-এর বেশ কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। পারিবারিক আবহের দরুন রুমী ছোট থেকেই ‘আদর্শ ছেলে’ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে বর্তমানের তরুণসমাজ পরতে পরতে শিক্ষা নিতে পারে।

উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যেখানে বাবা-মায়ের আয়ের টাকায় বিদেশ স্থায়ী হতে চায় কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলিউড-বলিউডের ফ্যাশন রপ্ত করে, সেই সমাজের প্রতিনিধি রুমীর মনের গহিনে লুক্কায়িত ছিল খাঁটি দেশপ্রেম। অসম্ভব মেধাবী রুমী আইএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এমনকি স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যাডমিশন নিয়েও ১৯৭১ সালে যুদ্ধের অগ্নিগর্ভে দেশকে রেখে তিনি যাননি। মেলাঘরে যুদ্ধের ট্রেনিং নেন এবং ঢাকায় গেরিলা বিচ্ছুদের বিশিষ্ট একজন হয়ে ওঠেন।

প্রশ্ন হচ্ছে রুমীর জীবন থেকে আমরা তরুণরা দেশপ্রেম ছাড়া আর কী কী শিক্ষা নিতে পারি? উত্তর হবে তার সমগ্র ব্যক্তিজীবনই শিক্ষার আধার। পারিবারিক রুচিশীলতা ছিল রুমীর ব্যক্তিজীবন গঠনে সহায়ক। তার মধ্যে আচার-আচরণ, আদব-কায়দায় পরিশীলিত রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তরুণরা এখন যেমন মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকেন, সেখানে তিনি ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ক্রিকেট, জুডো-কারাতে পারদর্শী ছিলেন। নিয়মিত ধর্মীয়চর্চাও করতেন। তিনি কোরআন খতম করায় তার নানা তাকে এনসাইক্লোপিডিয়া উপহার দেন বলেও জানা যায়। এর বাইরেও রয়েছে রুমীর বিপুল পাঠাভ্যাসের ইতিহাস। দেশের বাইরে বিশ্বসাহিত্যেও ছিল তার সমান আগ্রহ। রুমী মায়ের জন্মদিনে উপহার দেন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক লিয়ন উরিসের ‘মাইলা-১৮’ শীর্ষক উপন্যাসটি। কিংবা ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক লেনের ‘ইপক্রেস ফাইল’ নামক গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে তিনি শত্রুসেনাদের জিজ্ঞাসাবাদে স্থির থাকার কৌশল রপ্ত করেন। তার বিপুল পাঠাভ্যাসের প্রমাণ মিলে যখন রুমীর ফুফা একরাম সাহেব জাহানারা ইমামকে বলেন, ‘রুমীর সঙ্গে আলাপ করে আমি তো হতবাক। এইটুকু ছেলে এই বয়সে এত পড়াশোনা করে ফেলেছে? আগে তো ভাবতাম বড়লোকের ছাওয়াল হুশ হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়... চোঙা প্যান্ট পরে, গ্যাটম্যাট করে ইংরেজি কয়... আলালের ঘরের দুলাল। কিন্তু এখন দেখতেছি এ বড় সাংঘাতিক চিজ। মার্ক্স-এঙ্গেলেস একেবারে গুলে খেয়েছে। মাও সে তুংয়ের মিলিটারি রাইটিংস সব পড়ে হজম করে নিয়েছে।’ (‘একাত্তরের দিনলিপি’, ২২ এপ্রিলের ঘটনাবলি থেকে)।

বিপুল পাঠাভ্যাস স্বভাবতই জ্ঞানের জগৎকে সমৃদ্ধ করে, ব্যক্তির ভেতরে নৈতিকতাবোধ, ন্যায়-অন্যায়ের তফাত গড়ে তোলে। কাজেই তরুণদের নিয়মিত পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

বীরবিক্রম রুমীর এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে এসেছিল প্রেমও। আধুনিক সমাজের তরুণ-তরুণীরা যেখানে প্রেমকে বিষিয়ে তোলে, বিচ্ছেদে পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে, সেখানে রুমীর প্রেমে ছিল অসীমে লীন হওয়ার দীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে রুমীর চেয়ে দু-এক ক্লাস ওপরের এক পরমা সুন্দরী মেয়ে রুমীকে প্রেমের জগতে প্রবেশ করালেও শেষ অব্ধি রুমী ছলনাই পেয়েছিলেন। দুঃখ পেলেও সেই নারীকে তিনি রক্ত-মাংসের কোনো সাধারণ নারী হিসেবে আর দেখেননি, দেখেছেন বিশুদ্ধ প্রেমের প্রতীকস্বরূপিনী হিসেবে। রুমীর প্রেমবোধ তাই ধরা দেয় রবিঠাকুরের কবিতায়- ‘...জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা-/ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা,/পূর্ণের পদ-পরশ তাদের ’পরে।’ হিংসা নয় অসীমতায় প্রেমকে উত্তীর্ণ করাই ছিল যেন দীক্ষা। যার মধ্যে তরুণদের জন্য ভালোবাসার নির্মল বার্তাই পাওয়া যায়।

রুমী ছিলেন রাজনীতিসচেতনও। রাজনীতিবিষয়ক নানা বিষয় তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারতেন। রুমীর মতো মেধাবী তরুণরা বর্তমানে রাজনীতি থেকে বহুদূরে থাকেন। বলাবাহুল্য, অনেকে রাজনীতিকে শিক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ ও নিকৃষ্ট বিষয় বলেও মনে করেন। কিন্তু রাজনীতি এমন এক ক্ষেত্র যেখানে মেধার প্রয়োজন আরো বেশি। বর্তমান সমাজের মেধাবী তরুণ-তরুণী যদি এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসে, তাদের মেধা কাজে লাগায় তাহলে দেশ আরো সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করা যায়। সেজন্য দরকার আরো শত শত রুমীর যারা তরুণদের মধ্য থেকে উঠে এসে রুমীর আদর্শে উজ্জীবিত হবে, বহুমুখী গুণে চৌকস হবে এবং বিপুল পাঠাভ্যাস দিয়ে নিজের জ্ঞান ভাণ্ডারকেও সমৃদ্ধ করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close