ওসমান গনি
মুক্তমত
বিলীন হতে চলেছে কৃষিজমি
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশটির প্রায় ৮০ ভাগ লোকই প্রত্যক্ষও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। তা সত্ত্বেও নদীভাঙনের পাশাপাশি নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় এক লাখ হেক্টর কৃষিজমি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের ভূমির অর্ধেকই চলে যাবে শুধু বসতি স্থাপনের জন্য। তা ছাড়া হারিয়ে যাওয়া এই আবাদি জমির বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে অনুপস্থিত মালিকদের হাতে। এতে করে একদিকে জমি না থাকায় কৃষক ফসল উৎপাদন করতে পারবে না, অন্যদিকে টাকা বা ডলার হাতে থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত খাদ্য পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইক্যুইটিবিডির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং নদীভাঙনের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৮৯ হাজার হেক্টর কৃষিজমি হারিয়ে ফেলছে। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ভূমির ৫০ শতাংশই চলে যাবে শুধু বসতি স্থাপনের জন্য। পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, আবাদি জমি হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এগুলো চলে যাচ্ছে অনুপস্থিত মালিকদের হাতে। ১৯৬০ সালে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ পরিবার দেশের ৩৭ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল, বর্তমানে ৭০ শতাংশ পরিবার মাত্র ১৫ শতাংশ কৃষিজমির মালিক। ১৯৬০ সালে দেশে ১৯ শতাংশ মানুষ ভূমিহীন ছিল, ১৯৯৬ সালে ভূমিহীনের হার হয়ে যায় ৫৬ শতাংশ।
উন্নয়ন প্রকল্প বা আবাসন শিল্পের নামে আমাদের দেশে অনেক কৃষিজমি দখল হয়ে যাচ্ছে। ফলে একসময় আবাদি জমি খুঁজে পাওয়া ভার হয়ে যাবে। নীতিনির্ধারকরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করলেও বর্তমানে দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ নিয়মিতভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার, অর্থাৎ এরা সব সময়ই ক্ষুধার্ত থাকে। যদি চলমান গতিতে জমির পরিমাণ কমতে থাকে তাহলে একসময় আমাদের সবাইকেই অভুক্ত থাকতে হবে বলে ধারণা করছেন দেশের বিজ্ঞমহল। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে, পাশাপাশি কৃষকদের হাতে জমি পৌঁছে দিতে ভূমি সংস্কার করতে হবে। এতে খাদ্য উৎপাদন আরো বাড়বে।
আমাদের দেশে নগরায়ণ শিল্পায়ন ও নদীভাঙন মূলত এ তিনটি উপায়ে আবাদি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। নদীভাঙন প্রাকৃতিক হলেও বাকি দুটোর জন্য সম্পূর্ণ রূপে আমরাই দায়ী। তা ছাড়া আবাদি জমির বড় একটি অংশ পয়সাওয়ালাদের হাতে চলে যাচ্ছে। অথচ তারা সেখানে বসবাস করছেন না। কৃষিজমি রক্ষা করতে পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করতে হবে। পাশাপাশি জমি দখল বন্ধ করতে হবে। পরিতাপের বিষয়, দেশের সব অঞ্চলে এখন যেভাবে কৃষিজমির মাটি কাটা শুরু হয়েছে, তা যদি আমরা প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে এক দিন আমাদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। দেশে চরম আকারে দেখা দেবে খাদ্যের অভাব। বিশেষ করে কৃষিজমির উপরি ভাগের পলিমাটি সরিয়ে নেওয়ার কারণে এখন জমিতে আগের মতো ফসল ফলানো যাচ্ছে না। দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতিমাত্রায় ইটের ভাটা গড়ে ওঠার কারণে কৃষিজমির মাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের কৃষিজমি রক্ষা করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইনপ্রণয়ন জরুরি। ফলনশীল কৃষিজমি বিনষ্ট করে তাতে বাড়ি কিংবা অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান গতিময় উন্নয়নশীলতার ধারায় আমাদের দরকার পরিকল্পিত গ্রাম। পুরোনো সেই প্রবাদ ‘গ্রাম বাঁচলেই শহর বাঁচবে’- এ বার্তাটি সর্বাংশেই সত্য। গ্রামীণ পরিবেশ হলো মানুষের অক্সিজেন কারখানা। এটি দেশের মানুষের ফুসফুসস্বরূপ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের থাবায় যদি এই ফুসফুস ক্ষত-বিক্ষত হয় তাহলে স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ সুস্থ জাতি গড়ে তোলা দুরূহ হয়ে পড়বে। মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মতো সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে শুধু এর চতুষ্পার্শ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করে ফেলার কারণে। এমন আরো অনেক সভ্যতাই মানুষের হটকারিতার শিকার হয়ে ধরণীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ইতিহাসের এসব উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার চেতনা না জাগলে একই পরিণতি আমাদেরও বরণ করতে হবে। সে ধ্বংস আমরা ডেকে আনতে পারি না।
বলা হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাসন চাহিদার কারণে কৃষিজমি লোপাট হচ্ছে। আমরা মনে করি আবাসন চাহিদা মিটাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে কৃষিজমির ওপর চাপ কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পরিকল্পিত গ্রাম-নগরায়ণ ও গৃহায়ণ-প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষিজমিকে রক্ষা করা যায়। তাতে, কৃষিজমি যেমন রক্ষা পাবে, তেমনই আমাদের বর্তমান খাদ্য নিরাপত্তাও সংরক্ষিত থাকবে। দেশের কৃষিজমি রক্ষার জন্য আমাদের নিজেদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যা খেয়ে আমরা জীবন ধারণ করি তার ব্যবস্থা আমাদের সর্বাগ্রে করতে হবে। মাছে-ভাতে বাঙালি এ কথাটি আমাদের সবার মনে রাখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"