পল্লব কর্মকার

  ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

পুঁজিবিহীন লাভজনক ব্যবসা ‘ভিক্ষাবৃত্তি’

ভিক্ষাবৃত্তি একটি প্রাচীন পেশা। প্রাচীনকালে আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণে যাদের খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারা ক্ষুধা মেটানোর জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল ভিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করত। বর্তমানে সময় পাল্টেছে। এখন আপনি যেসব মানুষ নিজের শারীরিক কিংবা বার্ধক্যজনিক অক্ষমতার কথা আপনার কাছে দ্বিধাহীনভাবে ব্যক্ত করার মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য নিয়ে থাকে, তাদের সবাইকে ভিক্ষুক বলতে পারবেন না। হ্যাঁ, প্রাচীনকালে যারা ভিক্ষা করে জীবন ও জীবিকানির্বাহ করত, তাদের ভিক্ষুক বলা যেত কিন্তু বর্তমানে যারা ভিক্ষা করে তারা সবাই কি ভিক্ষুক? আপনি যখন কাউকে ভিক্ষা দিয়ে সাহায্য করবেন, ভাবছেন তখন তার পাশে বসে দুই মিনিট কথা বলুন। কথা বলতে বলতে যদি এমনটা শুনতে পান যে, ‘বাবজান সবটাকা তো আমি নেই না, অর্ধেক বিকেল বেলা মালিককে দিতে হয়।’ তখন আপনার কি মনে হবে ভিক্ষাবৃত্তি কি ভিক্ষার জায়গাতেই আছে, নাকি ভিক্ষাবৃত্তি এখন হয়ে গেছে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার একটি পুঁজিবিহীন মাধ্যম। তখন উত্তর পাবেন, হ্যাঁ, ভিক্ষাবৃত্তির প্রচলন প্রাচীনকালে শুরু হলেও আধুনিক সমাজে এটা রীতিমতো পেশায় পরিণত হয়েছে। পুঁজিবিহীন লাভবান ব্যবসা।

আজকাল শহর জীবনে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ভিক্ষাকে জীবিকানির্বাহের মাধ্যমে পরিণত করেছে। মানুষ এবং বয়স ভেদে ভিক্ষা চাওয়ার ধরন ভিন্ন ভিন্ন।

বৃদ্ধদের পাশাপাশি বাচ্চারাও ভিক্ষার সঙ্গে জড়িত। কোমলমতি শিশুদের

ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করছে কিছু মানসিকভাবে বিকৃত মানুষ। কখনো কি আপনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, এই বাচ্চারা কোন জায়গা থেকে আসে কোন জায়গায় যায়। প্রথম জীবনে ভিক্ষাবৃত্তি-পরবর্তী জীবনে হয়তোবা পতিতাবৃত্তি নয়তো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জড়িয়ে যাবে তাদের জীবন।

শহরের রেলস্টেশন থেকে শুরু করে শহরের প্রতিটি পয়েন্ট যেন ভিক্ষুকদের এক একটা জোনে পরিণত হয়েছে। বয়স এবং জায়গা ভেদে ভিক্ষার ধরন ভিন্ন। কিছু ভিক্ষুককে আপনি দেখতে পাবেন, ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে ওষুধ কেনার কথা বলে ভিক্ষা করছে। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও এটি একটি পেশা। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশন হাতে লোকটাকে ভিক্ষা দেওয়ার পর আপনি তার পিছু নিলে দেখতে পাবেন উনি কোনো খাবার হোটেলে বসে কাচ্চি খাচ্ছেন। আবার পার্ককেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে গেলে দেখা যায়, শিশুরা চকলেট কিংবা ফুল বিক্রির আদলে ভিক্ষা করছে। আদল বললাম এই কারণে যে, এই বাচ্চারা অনায়াসে একটা ফুলের মূল্য ৫০ কিংবা ১০০ চেয়ে বসে। হ্যাঁ, আপনি কথার আবেগে পরে ওই বাচ্চাকে ১০০ টাকা দিতেই পারেন। কিন্তু একই ঘটনা যখন প্রতিটি বাচ্চা ঘটাবে তখন? তখন কি আপনার এই আবেগ আর থাকবে? আপনি ভাবছেন ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাবেন পার্কে, কিন্তু পরিবারের সঙ্গে একটু স্বস্তিকর সময় কাটানোর উপায় নেই। ভিক্ষার সিরিয়াল যেন পার্কগুলোতে শেষই হতে চায় না। একজনের পর আরেকজন, আরেকজনের পর আরো একজন। তাদের সবার ভিক্ষার ধরন কিংবা চাহিদাও ভিন্ন। অনেক সময় আপনি যদি ভিক্ষা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন আপনার প্রতি জোরপূর্বক ভিক্ষা দাবি করা হবে। এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে, ভিক্ষা তাদের নাগরিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। আপনি আপনার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাবেন, সেখানেও ভিক্ষুক পদচারণ আছে। একইভাবে কিছু মহিলা ভিক্ষা করছে নবজাতক কোলে নিয়ে সুপার শপগুলোর সামনে। কি রকমারি ব্যবসা তাই না! ভিক্ষা যেন এক রকরমারি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে শহরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

গ্রামের ভিক্ষুকরাও পিছিয়ে নেই, যোগাযোগের আধুনিক কল্যাণে গ্রামের ভিক্ষুকরা বাস কিংবা ট্রেনের মাধ্যমে শহরে আসে ভিক্ষা করতে। সারা দিন ভিক্ষা শেষে খুব ভালো পরিমাণ অর্থ নিয়ে সন্ধ্যায় নিজ গ্রামে ফিরে যায়। ফেরার সময় তাদের চেহারা দেখে আপনি বুঝবেনই না, উনি ভিক্ষুক।

রবার্ট জনসন ভিক্ষুকদের নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন, ‘আজ পর্যন্ত আমার দেখা কোনো ভিক্ষুক স্বাবলম্বী বা দাতা হতে পারেনি। এর কারণ হলো যে মানুষ হাত নিতে অভ্যস্ত সে হাত কাউকে কখনো দিতে পারে না।’ তার মতবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে যাচ্ছি না। বাস্তব জীবন লক্ষ করলে দেখা যায়, আপনি যদি একজন সুস্থ ভিক্ষুক শ্রেণির মানুষকে কর্মের ব্যবস্থা করে দিতে চান তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আপনার প্রস্তাব মেনে নেবে না। স্বাভাবিকভাবেই, যেখানে হাত পাতলেই দিনের শেষে একটা মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়, সেখানে শারীরিকভাবে পরিশ্রম করে টাকা ইনকাম করাটা কার ভালো লাগবে বলেন? এই কথায় ভালো লাগার মানুষ আমাদের সমাজে কম।

যখন মানুষ শারীরিকভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম না হয়, বলতে গেলে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী যারা, তারা জীবন বাঁচানোর যখন ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে পারেন। কারণ বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিটা মানুষের রয়েছে। কিন্তু একজন শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষ যখন ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে, তখন সেই মানুষটা সমাজের জন্য ভয়ংকর অভিশাপে পরিণত হয়। কাজ করে অর্থ উপার্জনের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষাকে জীবিকানির্বাহের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে, সেই মানুষগুলো

সমাজের জন্য অভিশাপ। সমাজ তথা দেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এই মানুষগুলোর কারণে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close