নুসরাত জাহান পন্নি

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্ভ্রমহানি : দায় কার?

নারী যেন আজ শুধুই এক ভোগ্যপণ্য। ঘরে-বাইরে এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আজ আর নিরাপদ নয় তারা। শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) ঘটে যাওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আবাসিক হলে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা যেন এর জ্বলন্ত উদাহরণ। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলসংলগ্ন জঙ্গলে এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্তরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত মামুন (৪৫)। ঘটনার মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধনও করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

সারা দেশ যেন আজ ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে চলেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাইট হাউসের হিসাব মতে, দেশে ২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৩৬০ জন নারী। এর মধ্যে ৪৫০ জনকে আবার ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী। আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৩ উপলক্ষে সোমবার (৬ মার্চ) ‘মিডিয়া অ্যাডভোকেসি’ শীর্ষক এক সভায় এসব তথ্য জানায় সংস্থাটি।

এ ছাড়া কালের কণ্ঠ থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশের থানায় গত পাঁচ বছরে ২৭ হাজার ৪৭৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৬০টি।

শুধু বাড়ি কিংবা কর্মক্ষেত্রেই নয়, নারীরা আজ নিরাপদ নেই গণপরিবহনেও। চলন্ত বাসে তরুণী গণধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনার সাক্ষী ইতিমধ্যেই আমরা হয়েছি। ২০১৭ সালে একটি চলন্ত বাসে একজন তরুণীকে গণধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবুও এর মাত্রা কমছে না। এমনকি কিছুদিন আগেও আশুলিয়ার একটি বাসে গণধর্ষণের শিকার হন আরেক নারী। তারা না হয় একা ছিল। কিন্তু কক্সবাজারে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে বারবার গণধর্ষণের কথা কে না জানে।

বিআইএসআর ট্রাস্টের এক গবেষণায় (২০১৮) বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের নানা কারণ ওঠে এসেছে। গবেষণাটিতে ১১৯ জন ধর্ষণের ভিকটিম বা তার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং ৭টি ‘কেইস স্টাডি’ করা হয়েছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারীরা ধর্ষণ সংঘটনের যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন তা হলো- কথিত প্রতিশ্রুতিভঙ্গ বা ক্ষোভ থেকে অপরাধীর প্রতিশোধপরায়ণতা (৪০ দশমিক ৩ শতাংশ), অপরাধীর মাদকাসক্তি (৩০ দশমিক ৩ শতাংশ), অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা (২৮ দশমিক ৬ শতাংশ), ক্ষমতা প্রদর্শন (২১ শতাংশ), পরকীয়া (২০ দশমিক ২ শতাংশ), রাজনৈতিক কারণ (১৬ শতাংশ), পূর্বশত্রুতা ও সম্পত্তি-সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য।

ধর্ষণের ভিকটিম বা তার পরিবারের সদস্যদের জানা মতে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপরাধী বা অপরাধীরা ঘটনাকালীন নেশাগ্রস্ত ছিল। অনেক সময় মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা ভারসাম্য হারিয়ে পরিবারের নারী সদস্য এমনকি নিজ কিশোরী মেয়ে বা শিশুদের প্রতি যৌন দৃষ্টি দেয়। পারিবারিক পরিসরে কোনো শিশু বা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হলে অনেক ক্ষেত্রে তা দীর্ঘমেয়াদি চলতে থাকে।

ধর্ষণ সংঘটনের কৌশলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সর্বাধিক এক-তৃতীয়াংশ ঘটনায় নারীদের প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ বা জোরপূর্বক অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া অপরাধীরা নির্জন এলাকায় বা বাড়িতে ভিকটিমের একাকী অবস্থানের সুযোগ নিয়ে প্রায় ১৪ দশমিক ৩, জোরপূর্বক বাসায় প্রবেশ করে ১৪ দশমিক ৩, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে ১৩ দশমিক ৪ এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ধর্ষণ সংঘটন করেছিল। সংখ্যায় কম হলেও শিশুদের খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা মতে, ইদানীং অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের আশ্বাস থেকে প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে। পরে বিয়ে করতে ছেলেটির অনীহা দেখানোর প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (৩৭ শতাংশ) ধর্ষণের ঘটনায় বেকাররা জড়িত ছিল। এ ছাড়া ধর্ষণে জড়িতদের মধ্যে শিক্ষার্থী (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ), ব্যবসায়ী (১৪ দশমিক ৩ শতাংশ) ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী (১০ দশমিক ৯ শতাংশ) উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী মিলে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তার পরিমাণ ১১ শতাংশের মতো। তার অর্থ হচ্ছে রাজনীতি করলে ধর্ষণ করার প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে যায় না, যদিও তারা সংগঠিত শক্তি এবং নির্দিষ্ট আচরণবিধি মেনে চলার কথা। আবার দেখা যায়, অপরাধটি সংঘটনের পর অনেক ক্ষেত্রে দোষীরা প্রচলিত শাস্তি এড়াতে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে।

এ ধরনের জঘন্য এবং পাশবিক কাজের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অবদানই আমাদের দেশের তরুণদের। এর আরো একটি বড়সড় কারণ হলো ধর্মীয় এবং নৈতিক অনুশাসন মেনে না চলা। আমাদের চারপাশের সমাজে এখন শুধুই বিদ্রোহের গান। ধর্মীয় বা নৈতিক অনুশাসন মেনে চলা এখন ওল্ড ফ্যাশন। মাই লাইফ মাই রুলস- স্লোগানে সয়লাব চারপাশ। এসব করতে গিয়ে নিজের মাধ্যমে অন্য কারো কোনো ক্ষতি হলেও পরোয়া না করার মানসিকতা এখন ট্রেন্ডি।

আবার, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও এখন ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশাকে স্বাভাবিকীকরণ করার প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, পুরুষ বন্ধুর স্পর্শ হলো নিরাপদ স্পর্শ। অথচ জরিপেই উঠে এসেছে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে পরিচিত এবং কাছের মানুষের দ্বারাই।

শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের বড় বড় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ একই অবস্থা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রই যেন বদলে যায়। ঝোপের আড়ালে, খালি ক্লাসরুমে অথবা গ্রন্থাগারের কোনো এক কোনায় প্রায়ই কিছু শিক্ষার্থীদের আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যায়। কখনো ভিকারুননিসা নূন স্কুল কখনো ইডেন কলেজ আবার কখনো বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়- এভাবে লিস্টের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই যদি হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর শিক্ষার্থীদের অবস্থা, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কেমন সমাজ উপহার দিচ্ছি তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

যাই হোক, শিক্ষার্থীরা যেমন ভাঙতে পারে, ঠিক তেমনই গড়ার কারিগরও তারা। তারা যেমন নানা রকম রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে, ঠিক তেমনই সংঘবদ্ধভাবে তারাই একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করে দিতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্ম এবং নৈতিকতা কখনোই শিক্ষা এবং জীবনাচরণের বাইরের কোনো বিষয় নয়। বরং এগুলোর সমন্বয় ঘটিয়েই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। নয়তো শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, কলঙ্কিত হবে গোটা জাতিই। শুধুই কিছু সময়ের অপেক্ষা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close