মোস্তফা কামাল

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে বিএনপি

নতুন কোনো সাঁড়াশি আক্রমণ-মামলা না হওয়া এবং নেতাকর্মীদের কারো কারো জামিনে নির্বাচনের পর সরকারের একটি রাজনৈতিক শান্ত আবহ তৈরির গন্ধ পাচ্ছে বিএনপি। এই সুযোগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আস্তে আস্তে রাজনীতির মাঠে নামানোর চিন্তা ঘুরছে দলের একটি অংশের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ দফায় শপথের সান্ধ্য সময়েই খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় আনার মধ্যেও রাজনীতির রসদ দেখছে তারা। ক্ষমতাসীন কারো কারো ধারণা, কৌশলগত কারণে একটি নমনীয়তা ঘটলে বিএনপি আন্দোলনের নামে ডিস্টার্ব ক্ষান্ত দিয়ে সাংগঠনিক ক্রাইসিস কাটাতে মনোযোগী হতে পারে। এমন ধারণার সঙ্গে দ্বিমতও আছে।

ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খানসহ কারামুক্ত থাকা কয়েক নেতার সঙ্গে এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার বেশ যোগজিজ্ঞাসার তথ্য ঘুরছে বিএনপিকর্মীদের মুখে মুখে। তাকে সদরে না হোক অন্দর মহলে অ্যাকটিভ করার চেষ্টা আছে। তার নির্দেশনামতো বিএনপিতে পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের চেয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে নেতাকর্মীদের কারামুক্ত করাকে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে গত বছরের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বেশ হাঁকডাকেই চলেছে কর্মসূচি। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ দিলেও যথারীতি ৭ জানুয়ারি নির্বাচন তুলে নিয়ে ফের মসনদে বসেছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতির মাঠে অনেকটা নির্ভারেই এগোচ্ছে সরকার। এর বিপরীতে বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা শোনাচ্ছে নিয়মিত। চালিয়ে যাচ্ছে বিদেশি মহলের সঙ্গে যোগাযোগসহ ওঠাবসাও।

গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনের সড়কে আয়োজিত মহাসমাবেশ পুলিশের অভিযানে প- হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বরবাদ হয়ে যায় বিএনপির আন্দোলন। একে একে গ্রেপ্তারের শিকার হতে থাকেন শীর্ষ নেতারা। এরপর থেকে বিএনপি এবং সমমনাদের ১২ ধাপে ২৪ দিনের অবরোধ এবং পাঁচ ধাপে ছয় দিনের হরতালসহ ধারাবাহিক কর্মসূচি চলে। এ ছাড়া গত ২০ ডিসেম্বর নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি জনসাধারণের প্রতি সরকারকে অসহযোগিতার এবং তাদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ‘অসহযোগ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে জনসাধারণের মধ্যে লিফলেট বিতরণ চলে। সরকার সেদিকে একটুও কেয়ার না করে সেরে নেয় নির্বাচন। নির্বাচন হয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলেও বিএনপি নেতাদের দাবি, জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ভোটদানে বিরত ছিল। তাই এখন সাধারণ জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিফলেট বিতরণ করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। টানা বা অবিরাম এসব কর্মসূচি টানতে গিয়ে কাহিল কর্মীরা। কর্মসূচি নিয়ে ধোঁয়াশায়ও তারা।

আর ক্লান্ত না করে অন্তত ধরে রাখতে এখন কর্মীদের মুক্ত করাকে এ মুহূর্তে লক্ষ্য বাতলে দেওয়া হয়েছে দলের হিতাকাঙ্ক্ষী মহল থেকে। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপির প্রায় ২৩ হাজার নেতাকর্মী এখনো কারাবন্দি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এমন কোনো নেতা নেই যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। বিএনপির দাবি, সারা দেশে ১ লাখ ১১ হাজার মামলায় দলের প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অনেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না, বাড়িঘরে থাকছেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপির এই পরিসংখ্যান মানতে নারাজ সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১২ হাজারের মতো হবে। কয়েক হাজার ইতিমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

ভোটের পর নতুন প্রেক্ষাপটে আন্দোলন-কর্মসূচির ধরন ও কৌশল ঠিক করতে এরই মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা সাংগঠনিক পর্যায়ে ভার্চুয়াল বৈঠক শুরু করেছেন। সমমনা কয়েকটি জোটের সঙ্গেও পৃথক মতবিনিময় হয়েছে। এসব বৈঠকে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। মতামত ও পরামর্শ হিসেবে সবাই বলছেন, নতুন কর্মসূচির চেয়ে এ মুহূর্তে কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে বেশি মনোযোগী হতে। সেই দৃষ্টে আলোচনা হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। পরে তারেক রহমান ভার্চুয়াল বৈঠক করেন দলীয় আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতাদের সঙ্গে। দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে একটি সমন্বয় কমিটিও করা হয়েছে। এতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনকে। বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে আইনজীবী। বিভিন্ন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সমন্বয় করছেন জেলা নেতাদের সঙ্গে। নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীরা আটককৃত নেতাকর্মীর নথি সংগ্রহ করছেন। এসব মামলার বড় অংশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাদী পুলিশ। সাক্ষীরাও পুলিশ সদস্য। আইনজীবীদের জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা। বিচারব্যবস্থায়ও নতুন সংযোজন। এসবের বেশির ভাগ মামলাই জামিনযোগ্য বলে মত তাদের। এ অসিলায় তারা সরকার ও বিচারালয়ের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। গত তিন মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুজন উপদেষ্টা, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন যুগ্ম মহাসচিব, চারজন সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক, তিনজন নির্বাহী কমিটির সদস্য, ঢাকা মহানগরের তিন শীর্ষ নেতা, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং জেলাপর্যায়ের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে গেলে এসব মামলা হতো না বলে নিশ্চিত নেতারা। এখন আন্দোলনের চেয়ে তাদের মুক্ত করাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার একটি ফল আশা করতেই পারে বিএনপি। এরই মধ্যে কিছু ফল মিলছেও।

এমন ফল অব্যাহত থাকলে চলতি এবং আগামী মাসে ঢাকাসহ সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মন্ত্রান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চান তারা। সরকার অনুমতি দেবে কি না তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে কর্মসূচি বা সমাবেশকে ঘিরে সরকারের মানসিকতা দেখার সুযোগ মিলবে। সামনে রমজান মাস। রোজা সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম চড়া। সরকারের বিরুদ্ধে এটি মোক্ষম ও যৌক্তিক ইস্যু হতে পারে। ধীরে ধীরে আবার ফিরতে পারবে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে। সেই নমুনাও মিলছে। গুলশানে চেয়ারপারসন এবং নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খেলা হয়েছে। আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরাও একটু একটু প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন। আদালত থেকে নেতাকর্মীদের কারো কারো জামিন তো মিলছেই।

কৌশলী এই রাজনীতির পুরোভাগে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. মঈন খান। কূটনৈতিক অঙ্গনে বেশ সমাদৃত তিনি। তিনি বরাবরই মারদাঙ্গা বা সহিংস আন্দোলনবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা তাকে পছন্দ করেন বলে আলোচিত। এর বিপরীতে দলের মধ্যে ভীরু-আপসকামিতার বদনামও আছে তার। দলের একটি অংশ বরাবরই হরতাল, অবরোধ অব্যাহত রাখতে, সরকারকে চাপে ফেলতে ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াওর পক্ষে। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি মঈন খানের কারণে। কয়েক দিন আগে তারেক রহমানের সঙ্গে তার হটটকের কথা ছড়িয়ে পড়েছে দলীয় সীমানায়।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কারো কারো মধ্যে নেতিয়ে পড়া দলটি নিয়ে অতিকথনে সন্তুষ্ট বিএনপির একটি মহল। তারা মনে করেন, এসব কথা বলে মন্ত্রীদের কয়েকজন বিএনপির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ স্লোগানের মার্কেটিং করা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, খেলা শেষ হয়নি। এখন হবে রাজনীতির খেলা। তাহলে অর্থ কী দাঁড়াল? খেলা শেষ হয়নি? খেলা চলবেই? মানুষকে খেলা দেখতেই হবে? দৃশ্যত বিএনপি নামের বিরোধী দলটি এখানে কোনো ফ্যাক্টরই নয়। তারা ভার্চুয়াল পার্টি। তাদের অ্যাকটিভিস্ট এবং অনলাইন ফ্রেন্ডরা এখনো কোনটা কাউন্টার আর কোনটা হাইলাইটস করা সেটা এখনো বোঝে? এখনো পরদেশি আশায় দিনগুজরান হয় তাদের। স্যাংশন, নির্বাচনের বিভিন্ন সারমেয়দের প্রচারণায় এখনো একের পর এক স্ট্যাটাসে মশগুল তারা। বিএনপির খেলার সামর্থ্য থাক, না থাক খেলতে কী ছাড়ছে? বহুধাবিভক্ত আওয়ামী লীগকে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর অবিরাম চেষ্টায় শেখ হাসিনা এক করেছিলেন। প্রায় ৪৪ বছর পর ২০২৪-এর নির্বাচনের মাধ্যমে সেই আওয়ামী লীগ ঘরের মধ্যেই আবার বিভক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি এই নির্বাচনে না থাকলেও কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের ডামি-স্বতন্ত্রদের পক্ষে খেলার তথ্য কিন্তু গোপন নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close