আরিফুল কাদের

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট ডিগ্রি পাস কোর্স

ডিগ্রি পাস কোর্স জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৩ বছর মেয়াদি একটি কোর্স। এটিকে স্নাতক (পাস) কোর্স বলা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের তথ্যানুযায়ী দেশের ১৮০০ কলেজে প্রায় ৩ লাখ শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি রয়েছে। স্নাতক (সম্মান) তথা অনার্সের সঙ্গে ডিগ্রি পাস কোর্সের প্রধান পার্থক্য হলো বছর। ডিগ্রি পাস কোর্স ৩ বছর মেয়াদি, অন্যদিকে অনার্স ৪ বছর মেয়াদি। ডিগ্রিপড়ুয়া বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন কলেজের কিছু শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা যায় মূলত দ্রুত চাকরিতে প্রবেশের জন্যই শিক্ষার্থীরা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়। কেননা বাংলাদেশে শিক্ষক নিবন্ধন, শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে অনেক চাকরিতে ডিগ্রি শেষ করে অ্যাপ্লাই করা যায়। তারা এদিক দিয়ে অনার্সপড়ুয়াদের ১ বছর আগে থেকে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পায়। মূলত এই সুযোগ কাজে লাগাতেই তারা ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হয় বলে জানা যায়।

কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ভর্তি হওয়ার পর থেকে। সুযোগ যেন প্রতিনিয়ত অভিযোগে পরিণত হতে থাকে। ভর্তি নিশ্চায়নের পর থেকে শুরু হয় আসল সমস্যা। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে গিয়ে পড়ে বেশ বিপাকে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হবে, অতঃপর শিক্ষকরা তাদের সময়ে এসে পাঠদান করবেন। এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু না, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা গেছে শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হলেও শিক্ষকদের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। কখনো কখনো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেও দায়িত্বরত শিক্ষকদের কোনো খবর না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে আসে। আবার কখনো কখনো শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নির্দিষ্ট শিক্ষিকদের খুঁজে বের করে তাদের উপস্থিতির জানান দেয়। পরে বেশ লম্বা সময় পর শিক্ষকরা ক্লাসে উপস্থিত হলেও বেশিক্ষণ সময় দেন না। অল্প কিছু পড়া পড়িয়ে অবশিষ্ট সময় কথা বলে কাটিয়ে দেন। এভাবেই চলে শ্রেণি কার্যক্রম।

তবে এখানেও রয়েছে বেশ হতাশা। শিক্ষকরা তাদের ক্লাস শুরুই করেন শিক্ষার্থীদের হতাশ করে। তারা কথায় কথায় ডিগ্রি পাস কোর্সকে হেয় করেন। এখানে কেন ভর্তি হয়েছো? ডিগ্রি করে কিছুই করা যায় না, দিনশেষে বেকার থাকতে হয়, অনার্স-মাস্টার্স করেও মানুষ কিছু করতে পারে না, আর তোমরা এসেছো ডিগ্রি করতে? তোমরা ভুল করেছো। তোমরা কিছুই করতে পারবে না। চাকরির বাজারে তোমাদের জন্য কোনো চাকরির ব্যবস্থা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি অযাচিত প্রসঙ্গে তারা আলাপ-আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের হতাশ করেন। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা করার মূল কারণ হলো ভালো একটি চাকরি পাওয়া। বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যেকোনো বিষয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত দক্ষতাকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হয়। সে অনার্স করুক বা ডিগ্রি করুক। কিন্তু তার পরও শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজ এমনকি দেশ প্রত্যকটি জায়গায় ডিগ্রি পড়ুয়াদের হেয়ভাবে দেখা হয়।

ডিগ্রিতে প্রধানত ৪টি কোর্স রয়েছে। বিএ, বিএসএস, বিবিএস ও বিএসসি। এখানে একেক কোর্সে একেক রকম সাবজেক্ট থাকে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের সাবজেক্টের কিছু মিলে তো কিছু মিলে না। এ কারণে এখানে নির্দিষ্ট কোনো কাউন্সিলিং টিচার নেই। ফলে তাদের সমস্যার যে লাউ, সে কদু হয়েই থেকে যায়। ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা কোর্সভিত্তিক কাউন্সিলিং টিচার চায়। অর্থাৎ বিএ কোর্সের জন্য একজন শিক্ষক থাকবেন। আবার বিএসসির জন্য আলাদা অন্য একজন শিক্ষক থাকবেন। এভাবে প্রতিটি কোর্সের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক থাকবে। বিএ কোর্সের শিক্ষার্থীরা বিএ কোর্সের দায়িত্বরত শিক্ষকদের কাছে থেকে তাদের সমস্যার সমাধান নেবে। এভাবে অন্য কোর্সের শিক্ষার্থীরাও তাদের কোর্সের দায়িত্বরত শিক্ষকের কাছে তাদের সমস্যা পেশ করে সমাধান চাইবে। এতে করে তাদের ভোগান্তি অধিকাংশে লাঘব হবে বলে ধারণা করা যায়।

এবার আসি বৈষম্যে। অনার্স ও ডিগ্রি জাতীয় বিশ্বিদ্যালয়ের দুটি কোর্স। উভয় কোর্সের প্রশ্নের ধরন ও মানবণ্টন পুরোপুরি একই রকম। উভয় কোর্সে প্রতিটি সাবজেক্টে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়ে থাকে। ২০ নম্বর থাকে ইনকোর্সে ও অবশিষ্ট ৮০ নম্বরে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে থাকে। এই ৮০ নম্বরের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য অনার্সের শিক্ষার্থীদের সময় দেওয়া হয় ৪ ঘণ্টা। অন্যদিকে ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের সময় দেওয়া হয় ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। অর্থাৎ একই কাঠামোতে পরীক্ষা দিলেও সময়ের ক্ষেত্রে ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের ৩০ মিনিট সময় কম দেওয়া হয়। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সময়ের অভাবে পুরোপুরি লিখতে পারে না। ফলে তারা অনেক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে।

এবার আসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বছর শেষ হয়ে গেলেও বর্ষ শেষ হয় না। বছর চলে যায়। কিন্তু বছর শেষেও শিক্ষার্থী সেই একই বর্ষে পড়ে থাকে। লোকলজ্জায় তারা কোন বর্ষে পড়ে তা বলতে সংকোচবোধ করে। কারণ একই সঙ্গে পড়াশোনা শুরু করা তার অনার্স বা অন্যান্য কোর্সের সহপাঠীরা যেখানে পরীক্ষা শেষ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়, সেখানে ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা অপেক্ষায় থাকে, কখন পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ হবে। ডিগ্রি পাস কোর্সের ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয় বছরের শেষ দিকে। বলতে গেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও অন্যসব কোর্সের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে ডিগ্রির ভর্তি শুরু হয়। সেদিক দিয়েও ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে। কোনো কারণে যদি অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, কিংবা পরীক্ষা স্থগিত হয় তাহলে তা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। বিভিন্ন বাঁধা ডিঙিয়ে যখন পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ হয় তখন দেখা যায় আরেক সমস্যা। ডিগ্রির সব কোর্সে সাধারণত আবশ্যিকসহ ৭টি বিষয়ে পরীক্ষা হয়। মাত্র ৭টি বিষয়ের পরীক্ষার জন্য সময় দেওয়া হয় বেশ দীর্ঘমেয়াদি। যেমন- ডিগ্রি পাস কোর্সের ২০-২১ সেশনের কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বিগত ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখ। সেই পরীক্ষা শেষ হয় মার্চ মাসের ১২ তারিখ। প্রায় ২ মাসের অধিক সময় ধরে চলে পরীক্ষা। সেই রেজাল্ট প্রকাশিত হয় জুলাই মাসের ১৯ তারিখে। প্রায় ৪ মাসেরও অধিক সময় লেগেছিল রেজাল্ট পাবলিশ হতে। আগেই বলেছি, ডিগ্রির ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয় অন্যান্য কোর্সের কার্যক্রম শেষ করে বছরের শেষের দিকে। সেদিক দিয়ে বছরের অর্ধেক সময় শেষ হয়ে যায় ভর্তি কার্যক্রমে। বাকি অর্ধেক যায় পরীক্ষা, রেজাল্ট পাবলিশ হতে হতে। অর্থাৎ ভর্তি, পরীক্ষা, রেজাল্ট ও অন্যান্য কার্যক্রম মিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রায় ১ বছরের কাছাকাছি সময়। বিষয়টি একটু স্পষ্ট করলে এমনভাবে বলা যায়, ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই ১ বছর পিছিয়ে পড়ছে। অনেকের যেই কোর্স ২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা, ২৪ সালে এসেও তারা এখনো পরীক্ষার খবর জানে না। শেষ হওয়া তো পরের কথা।

এমন আরো বঞ্চনা, বৈষম্য রয়েছে। তার ওপর সেশনজট যেন মড়ার উপর এক খাঁড়ার ঘা। ডিগ্রি পাস কোর্সের ১৯-২০, ২০-২১, ২১-২২ সেশনের বেশকিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত আমরা জানতে চেয়েছি। তাদের সুস্পষ্ট কথা হলো ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্সের সেশনজট শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। ৩ বছরেই কোর্স শেষ করতে হবে। ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত যে বঞ্চনা, অবজ্ঞা, অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা নিরসনে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিগ্রি পাস কোর্সের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা যদি এ সমস্যা সমাধানে অনীহা প্রকাশ করেন তাহলে তারা বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে রিট করবেন বলেও জানান। অতএব ডিগ্রি পাস কোর্সের প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের সমস্যার সমাধান করতে আমরা দৃঢ়ভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close