আবদুল্লাহ আল মুনাইম

  ১২ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি

নতুন বছর শুরু হলেও এখনো চলছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সার কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, নিত্যদিনের কাঁচাবাজারসহ সবকিছুর মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধিতে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। নতুন বছরে মূল্যহ্রাসের আশায় নিম্ন আয়ের মানুষ। ভরা মৌসুমেও সবজি ও চালের অস্বাভাকিক দাম। ডিম, পেঁয়াজ, মুরগির মাংস, আলুসহ নিত্যপণ্যের দামে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। কোথাও যেন স্বস্তির অবকাশ নেই। আছে শুধু নতুন করে বেঁচে থাকার আকুতি। হয়তো সুদিন ফিরবে এক দিন, থামবে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২৩ সাল জুড়েই নিত্যপণ্যের বাজার চরম অস্থিতিশীল ছিল। নতুন বছরের শুরুতে ভরা মৌসুমেও শীতের সবজির দাম কমার নাম নেই। ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজি বিক্রি হচ্ছে লাগামহীন দামে। বিভিন্ন আকারের ছোট-বড় ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম এখনো ৫০ থেকে ৬০ টাকা। স্থানভেদে দাম কম-বেশি হলেও গড়ে বাজারদর একই। আগে পিস হিসেবে বিক্রি হলেও গ্রামগঞ্জে এখন বাঁধাকপি, ফুলকপি কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা যায়, যা আগে কখনো দেখেনি মানুষ। ৬০-৮০ টাকার নিচে লাউ পাওয়া যাচ্ছে না। সিমের কেজি ৮০ টাকার নিচে যেন নামছেই না। নতুন আলু নামলে দাম কিছুটা কমবে বলা হলেও এখন নতুন-পুরাতন আলু প্রায় একই দামে বিক্রি হচ্ছে। নতুন-পুরাতন আলু দুটিই এখন ৭০-৮০ টাকা কেজি, যা বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি বছর ভরা মৌসুমে নতুন আলু ২০-৩০ টাকায় নেমে এলেও এ বছর দাম কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। লালশাকের আঁটি ২০-৩০, লাউশাক আঁটি ৬০-৭০, মুলাশাক ২০-২৫, পালংশাক ২০-৩০ ও কলমিশাক ১৫-২০ টাকা আঁটি বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। শীতের মৌসুমে উৎপাদিত টমেটো এখনো ৭০-৮০ টাকা কেজি। ক্রেতারা বলছেন, শীতে সব সময় বাজারে সবজির দাম একটু কম থাকলেও এ বছর যেন লাগামহীন বাজারদরে কিনতে হচ্ছে তাদের।

শীতের শুরু থেকে এখনো কোনো শাকসবজির দাম কমতে দেখা যায়নি। উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। অদৃশ্য সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যেন কাটছেই না। বিক্রেতারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে রকম দামে শাকসবজি আসে, তারা সে রকম দামেই বিক্রি করেন। এ বছর এলাকা থেকেই দাম একটু চড়া। কিন্তু এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ন্যায্য দামেই তারা তাদের ফসল বিক্রি করেন। অধিক সময় রাখলে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় কম দামেও বিক্রি করতে হয় তাদের। অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, কৃষকদের কাছে ফসল রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় সুযোগ না থাকায় সুবিধাবাদী কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার যেন কেউ নেই। ভরা মৌসুমেও বাজারগুলোতে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের সবজি এবং মাছ। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার। বেসরকারি এক স্কুলশিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। তিনি আরো জানান, এখন ১০০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে একটি পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। কোনো কিছুর দাম কমছে না বরং সব বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের বেতনে পরিবারের ভরণ-পোষণ আর সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টাকা জমাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে সংসারের ব্যয় যেন ততই বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের স্কুল-কোচিংসহ নানা মাসিক খরচ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

বাজারবিশ্লেষকরা বলেন, গত নভেম্বর মাসেও দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং যা অক্টোবরেও ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও পারেনি বাংলাদেশ। অথচ ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কাও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে দেশের শহর ও গ্রামে দ্রব্যমূল্য বেশি ছিল। তিনি আরো বলেন, খাদ্য সরবরাহকারী বড় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে নিয়ন্ত্রকদের নজর এড়িয়ে যেতে পেরেছেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং তার সঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন খাতে মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। গত এক বছরের ব্যবধানে শুধু ব্যাংকিং খাতেই আমানত কমেছে ৪৫ শতাংশ। সাধারণ মানুষ ব্যাংক-বীমা খাতে সঞ্চয়ের সুযোগ পাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বারবার সিন্ডিকেটের কথা বলা হলেও তাদের বিরুদ্ধে নেই কোনো সঠিক ব্যবস্থা। একদিকে সাধারণ কৃষক যেমন ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারাও চড়া দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ঠকছেন। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা যায়, এ বছর এক কেজি বেগুন উৎপাদনে খরচ হচ্ছে গড়ে ১০ টাকার কিছু বেশি। অথচ কিছু হাত ঘুরে শহরের বড় বড় বাজারে খুচরা বেগুন কিনতে হয় ১০ গুণেরও বেশি দাম দিয়ে। বিভিন্ন হাত ঘুরে খুচরা বাজারে সেই বেগুন ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে ১০ গুণের বেশি দামে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানান, উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনতে বিভিন্ন চাঁদাবাজির সম্মুখীন হতে হয়। এসব চাঁদাবাজি যেন ওপেন সিক্রেট। একই অবস্থা অন্যসব সবজির ক্ষেত্রেও। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারি সংস্থাগুলোর যথাযথ তদারকি আর সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে নিয়ন্ত্রণহীন দেশের বাজার।

বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির গড়ে ১৩ শতাংশ, যা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষই খাদ্যসংকটে আছে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যান এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দুবেলা ঠিকমতো খেতে না পারা মানুষের কাছে মুরগির মাংস খাওয়াও যেন বিলাসিতা। বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সেটার সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তা ভোগ করছে। সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাংলাদেশে হয়নি। এ ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান খাতেও তেমন কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে কবে? কবে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলবে সাধারণ মানুষ- এটাই দেখার বিষয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close