অলোক আচার্য

  ২১ নভেম্বর, ২০২২

বিশ্লেষণ

বৈশ্বিক শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক মন্দা

বৈশ্বিক অর্থনীতি ভুগছে। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অর্থনীতি চাপে রয়েছে। অর্থনীতির এই দুঃসময়ে কাজ হারাচ্ছে বহুসংখ্যক মানুষ। অথচ এ কাজই তাদের পরিবারের অন্ন জোগানোর একমাত্র অবলম্বন। এই চাপ থেকে সহসাই বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রাতারাতি বৈশ্বিক পরিস্থিতি বদলে যাবে না। করোনার সময় থেকেই যে সংকটের শুরু হয়েছে তা আরো গভীর করে দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। করোনার সময় থেকেই বিশ্বে অন্যান্য সংকটের সঙ্গে তীব্রতর হতে থাকে কর্মী ছাঁটাই, যা এখনো চলছে। বৈশ্বিক শ্রমবাজার এখন মন্দা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তির একটি দিক হলো শ্রম। বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছে। এই শ্রমশক্তিই আমাদের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া হয়। করোনা শুরুর পর থেকে যা ধাক্কা খায়। জাতিসংঘের শ্রমবিষয়ক সংস্থা আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক শ্রমবাজারে তীব্র মন্দা চলছে। কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান অর্থনৈতিক সংকটে এরই মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন অন্তত চার কোটি মানুষ। সামনের দিনগুলোতে এই মন্দা আরো তীব্র হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশি^ক শ্রমবাজার কয়েক মাস ধরেই ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। গত তিন মাসে বৈশি^ক শ্রমবাজারের প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের শেষে বেকারত্ব আরো বাড়তে পারে। সংস্থাটি জানায়, জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা সংকট, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, আর্থিক নীতি কঠোর করা এবং বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কার মধ্যেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার এবং কাজের মান উভয়ই হ্রাস পাচ্ছে। কর্মক্ষম মানুষ যখন কর্মহীন অবস্থায় থাকে তখন সেই দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়াটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের হয়। সেই ধাক্কা সামলানোও বেশ কঠিন। এটা শুধু আমাদের দেশের অবস্থা নয়। সারা বিশ্বেরই কমবেশি একই পরিস্থিতি।

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত যক্তরাজ্যে বেকারত্বের হার বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পৌঁছে গিয়েছিল এবং তা অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়েছিল। বেকারত্ব সমস্যা স্বাভাবিক সময়েই অধিকাংশ দেশের জন্যই মাথাব্যথার কারণ। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় বেকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। এখন অর্থনৈতিক দুর্যোগের কারণে সেই লক্ষ্য কতটা পূরণ করা সম্ভব সেটাই প্রশ্ন। কারণ সারা বিশ্বেই ওলটপালট অবস্থার তৈরি হয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাত বন্ধ রয়েছে, যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থনীতির অভিঘাত আসে বিভিন্ন দিক থেকে। এর মধ্যে বৈশি^ক শ্রমবাজার গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রধান দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ, মালয়েশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ আরো কয়েকটি দেশ। এসব বেশির ভাগ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এ সময় হিমশিম খাচ্ছে।

বৈশ্বিক মন্দা বা মহামন্দা সম্পর্কে যারা একটু জ্ঞাত আছেন তারা জানেন, এটা বিশ্বের জন্যই ক্ষতিকর এবং এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার বিকল্প থাকে না। মহামন্দার একটি দিক হলো সবার জন্য কাজের নিশ্চয়তা না থাকা। অর্থাৎ বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া। পর্যাপ্ত কাজের জোগান না থাকা। শ্রমিক থাকলেও শ্রমের সুযোগ না থাকলে তা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তখন তা পরিবারের মৌলিক দ্রব্যগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারে না। খাাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ এবং বণ্টন নিশ্চয়তার সঙ্গে, শিল্প-কলকারখানার গতি, বেকারত্ব বৃদ্ধিতে লাগাম দেওয়া, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জনগণের জীবনের ওপর চাপ কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপ নিতে হলে যুদ্ধ থামিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতির এই তালিকায় ধনী-দরিদ্র সব দেশই রয়েছে।

খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থাপনার এক চিত্রে তুলে ধরা হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ৪৫টি দেশের ২০ কোটি ৫১ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগবে এবং ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে। সোমালিয়ার উপকূলবর্তী তিনটি অঞ্চলে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রবল খাদ্য সংকটের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের মূল্য ৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে রপ্তানি মূল্যসূচক কমেছে ২ শতাংশ। অর্থনৈতিক মন্দার অভিজ্ঞতা বিশ্বের আছে। অর্থনীতিতে মন্দা এবং মহামন্দা দুটি শব্দই প্রচলিত আছে। এই দুটি পরিস্থিতির মুখোমুখি এর আগেও বিশ্ব হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে এক তথ্যে জানান, বিশ্বের ৮২টি দেশের অন্তত ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ চূড়ান্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, সে ক্ষেত্রে শিগগির এই সংখ্যার সঙ্গে আরো ৭০ কোটি মানুষ যুক্ত হবেন। তিনি আরো বলেন, করোনা মহামারির শুরুর পর্যায়ে বিশ্বজুড়ে যত সংখ্যক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল, মহামারির আড়াই বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বিগত ৪০ বছরেও দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছর নাগাদ বিশ্বমন্দার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটি ঠেকানো সম্ভব কি না- সে বিষয়ে বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থনীতি যে গতিতে চলছে তাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অবস্থায় অর্থনীতির সংকোচন বা মন্দা আসন্ন। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও এখন বিশ্বেও প্রায় দেশ আগের অবস্থায় ফিনে যেতে পারেনি। অর্থনীতিতে মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলো সমন্বিতভাবে করতে হবে। হঠাৎ নেওয়া এই উদ্যোগ ধাপে ধাপে নিলে অর্থনীতিও সহনীয় হবে। নীতি সহায়তাগুলো হঠাৎ তুলে না দিয়ে বাজার চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে করতে হবে। মধ্য মেয়াদে একটি কাঠামোরালোকে নীতি সহায়তা সাজাতে হবে।

শ্রমবাজার, নিত্যপণ্য এবং বাণিজ্যিক নীতিগুলো সমন্বয় করতে হবে। এর মধ্যে ইউরোপের কথা উল্লেখযোগ্য। সেখানে গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ১৯৯৭ সালের পর সর্বোচ্চ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইউরো ব্যবহার করে এমন ১৯টি সদস্য রাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা আঘাত করেছে প্রধানত ইউরোপে। এই অস্থিরতার পেছনে যে জ্বালানি সংকট কাজ করছে তা আর নতুনভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানকার দেশগুলো মূল্যস্ফীতির কঠিন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া এসব সংকট কোথাও কোথাও রাজনৈতিক অস্থিরতারও জন্ম দিচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্লেষকরা আসন্ন মন্দা ইউরোপ থেকেই শুরু হবে বলে মনে করছেন। ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতি বিগত ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য মতে, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং চেক রিপাবলিক এই তিনটি দেশ বাজে অবস্থার ভেতর পার করছে। এই তিন দেশে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের অপর্যাপ্ততা, মূল্যবৃদ্ধি এবং অতীতের তুলনায় ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি পৃথিবীকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। টানা দুই বছর করোনায় বিপর্যস্ত উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা আরো বড় ধাক্কা খায় চলতি বছরে এসে। যদিও করোনা প্রায় থেমে যায় কিন্তু যুদ্ধ সেই মন্দার গতিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই উচ্চ মূল্যস্ফীততে বিশ্ব এখন রীতিমতো নাকাল হওয়ার অবস্থায়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এর প্রভাবে ব্যাপকভাবে ভুগছে। এর মধ্যেই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে দীর্ঘায়িত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফলে খুব দ্রুতই যে এ সমস্যার সমাধান হবে সেটাও আশা করা যায় না। পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এ মন্দার হাওয়া থেকে বাদ যাবে না। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বেই দরিদ্রতা গ্রাস করছে। ভয়াবহভাবে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। সেটা সামাল দেওয়া বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জের। এই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা সম্ভব না। কারণ কোনোভাবেই যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরো অনেক দিন হয়তো এ অবস্থা বিরাজ করবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রথমেই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে এবং জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক করতে হবে। যদিও প্রকৃতিও কিছুটা দায়ী তবু বিশ্ব যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে তাহলে আসন্ন সংকট মোকাবিলা করতে পারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close