দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মুক্তমত

বন্ধ করতে হবে বাল্যবিয়ে

বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে দেশ কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারছে না। না আইন করে, না শাস্তি দিয়ে, না সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে। কোনোভাবেই ক্ষতিকর এই রেওয়াজটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। করোনা মহামারির দুই বছরে এই রেওয়াজটি আরো ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাল্যবিবাহ : একটি দ্রুত অধ্যয়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে এমনই তথ্য। গত রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারির প্রথম বছরে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের ২৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর মহামারির দ্বিতীয় বছরে বিয়ে হয়েছে ৩৪ শতাংশের। প্রতিবেদনে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি গ্রুপ বিবেচনা করার পেছনের যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, জরিপকালে ১৯ বছর বয়সি বেশ কিছু মেয়েকে পাওয়া গেছে, যাদের বয়স ২০২০ ও ২০২১ সালের শুরুতে ১৮ বছরের নিচে ছিল।

শুধু বর্তমান জরিপেই নয়, এর আগেও বেশ কিছু জরিপে একই রকম তথ্য ওঠে এসেছে। কয়েক মাস আগে রাজশাহী জেলা শিক্ষা দপ্তর করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, মহামারির দুই বছরে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বাল্যবিয়ের শিকার এই মেয়েদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী, এই জেলায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিপড়ুয়া সাড়ে ছয় হাজার শিশুর বিয়ে হয়েছে এই সময়ে। তালিকায় প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য থাকলে সেখানেও এমন চিত্র কমবেশি পাওয়া যেত বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় ওঠে এসেছে, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে ১৩ শতাংশের মতো। প্রকাশিত অন্য এক খবরে জানা যায়, বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় ছয় শতাধিক কন্যাশিশুর বিয়ে হয়েছে গত দুই বছরে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। প্রায় একই ধরনের খবর পাওয়া যায় রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে।

এসব তালিকায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অনেক মেয়ে রয়েছে যাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের বয়স কত ১২ থেকে ১৪ বছর হতে পারে। এই বয়সে একটি মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়াকে অনেকেই হত্যার শামিল অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন। কোনো সভ্য সমাজে এমনটা কল্পনাও করা যায় না। অথচ আমাদের এখানে এমন অপরাধ প্রতিনিয়ত ঘটছে। অনেক স্থানে মেয়েরা নিজেরাই প্রতিবাদী হচ্ছে। কিন্তু সমাজের কিংবা প্রশাসনের প্রতিবাদ কোথায়!

বাল্যবিয়ের ফলে মেয়েদের এভাবে হারিয়ে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রেরও ক্ষতি। সুযোগ পেলে বাংলাদেশের মেয়েরাও যে অনেক কিছু করে দেখাতে পারে, শিক্ষা, খেলাধুলাসহ অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা তা প্রমাণ করেছে। ছেলেদের ফুটবল যখন কোনো কিনারা পাচ্ছে না, মেয়েরা তখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা পরিসরে শিখরে ওঠার সামর্থ্য দেখিয়েছে। তাই মেয়েদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসকারী ও জীবন ধ্বংসকারী বাল্যবিয়ে যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।

দেশে জন্মনিবন্ধনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা না থাকায় বয়স বাড়িয়ে বা কমিয়ে যেকোনো বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন প্রচলিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিয়ে বৈধ করতে পাত্রপাত্রীর বয়স বাড়ানো হয় বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে। আর নিবন্ধনহীন বিয়ে তো বাংলাদেশে ঘটছে অহরহ। সেখানে বয়সের কোনো বালাই নেই। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ১০-১১ বছরে মেয়েদের এবং ১৫-১৬ বছর বয়সে ছেলেদের বিয়ের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অধিকাংশ মা-বাবা অল্প বয়সে কন্যাশিশুকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। বখাটেদের উৎপাতে প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক স্কুলছাত্রী ও তরুণী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দলের নেতৃত্বে দুই যুগের বেশি রয়েছেন নারী নেত্রীরা। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষি, শিক্ষা দপ্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তারা। এ মুহূর্তে স্পিকার পদেও রয়েছেন একজন নারী। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের সঙ্গে যুক্ত ৪০ লাখের বেশি শ্রমিকের সিংহভাগই নারী। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হলেও আলোর নিচে রয়েছে অন্ধকার। বিশ্বে তিনটি দেশে বাল্যবিয়ের হার বেশি বাংলাদেশ তার একটি। বাল্যবিয়ের আধিক্যের পেছনে বখাটেদের উৎপাত অনেকাংশে দায়ী। বাবা-মায়েরা মানসম্মান বাঁচাতে কন্যাসন্তানদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হলে আগে মানবশকুন নামধারী বখাটেদের নিরস্ত করতে হবে। মেয়েদের শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার পেছনেও দায়ী বখাটে নামের জঘন্য জীবরা। তাদের না ঠেকিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধের ব্যবস্থাপত্রে কোনো কাজ হবে না। করোনাকালে দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির পেছনে প্রধানত কাজ করেছে স্কুল বন্ধ থাকার ঘটনা। অর্থনৈতিক সংকটে পড়েও অনেকে মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছেন। তবে একে মূল কারণ না ভেবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা নিলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা রোধ করা অনেকাংশে সম্ভব হবে।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close