মো. নাজমুচ্ছাকিব

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২২

দৃষ্টিপাত

শিক্ষা পদ্ধতিতে উন্নয়ন জরুরি

কথিত আছে, ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন’। আলোচ্য প্রবচনটি অধিক যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত। তাই আমাদের গ্রন্থের বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি হাতে-কলমে দক্ষ হতে হবে। তা ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে জাপানের পাঁজর ভেঙে দিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু হাতে-কলমে দক্ষতা ও উন্নয়নের মাধ্যমে আজ জাপান অনেক উন্নতি করেছে। আজ জাপানি প্রোডাক্ট সারা বিশ্বে সমাদৃত। অন্যদিকে চায়না আজ সারা বিশ্বে ক্লোন প্রোডাক্ট তৈরি করে বেশ নাম কামিয়েছে। চায়নার প্রত্যেকটা জনগণ বেশ পরিশ্রমী। চায়না তার দক্ষ প্রকৌশলীদের আন্তরিক তত্ত্বাবধানে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবে দৃশ্যমান। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের পর স্বাধীন হয়ে কারিগরি সেক্টরে উন্নয়নের মাধ্যমে অনেক উন্নত হয়েছে।

কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আজ গ্রন্থগত বিদ্যার মধ্যে পড়ে আছে। দেশের ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভালো চাকরি করবে। কিন্তু শিক্ষা অর্জন করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ ও জাতির খেদমত করবে, এই ইচ্ছা কারোর নেই। এর পেছনে অবশ্য আমাদের বাবা-মা দায়ী। দায়ী শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা। কিন্তু আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে চোখ রাখি তবে এর ভিন্নতা দেখতে পাব। অধিকাংশ শিক্ষার্থী আজ মুখস্থগত বিদ্যার পেছনে পড়ে আছে। কিন্তু হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন করছে না। হাতে-কলমে শিক্ষাদান করে একটা সমৃদ্ধ জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড’, যার অধীনে সরকারি-বেসরকারি মিলে কয়েক হাজার পলিটেকনিক রয়েছে সারা দেশে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি পলিটেকনিকের একজন জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ছাত্রদের উদ্দেশে বলছেন, ‘এখন অ্যাসাইনমেন্ট লিখে ভালো রেজাল্ট নিয়ে যাও। কাজ শেখার জন্য অনেক সময় পাবে।’ এই যদি হয় শিক্ষকদের অবস্থা তবে ছাত্ররা শিখবে কীভাবে?

প্রতি বছর কারিগরি বোর্ডের অধীনে কয়েক হাজার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার পাস করে বের হয়ে থাকেন। কারিগরি বোর্ড সিভিল, কমপিউটার, ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিকসহ প্রায় ৩২টি বিভাগের ওপর আলাদা করে চার বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দিয়ে থাকেন। যারা উপসহকারী প্রকৌশলী পদে জব করে থাকেন। কিন্তু প্রতি বছর আমাদের দেশে এত প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন চোখে পড়ে না। আসলে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ ছাড়া কখনো প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সম্ভব নয়। চায়নার ভার্সিটিগুলোতে রয়েছে সমৃদ্ধ ল্যাব এবং বাস্তব প্রশিক্ষণের জন্য নিজস্ব ফ্যাক্টরি। যেখানে নিয়মিত পণ্য উৎপাদন করা হয়। পুথিগত বিদ্যার সঙ্গে সমান তালে রয়েছে বাস্তব প্রশিক্ষণ। তাই এখানের ইঞ্জিনিয়াররা বিশ্বে নাম করেন। আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিগুলোতে গবেষণা খাতে প্রতি বছর যে পরিমাণ বরাদ্দ হয় তার সঠিক ব্যবহার এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা-বাণিজ্য বন্ধ করে গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে বাস্তব প্রশিক্ষণ দিতে পারলে এত দিনে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারও অনেক এগিয়ে যেত এবং বিশ্বে নাম করত। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়! তা ছাড়া দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাস্টার্সে যাওয়ার আগে গবেষণা কী, রিসার্চ পেপার কী- এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ২০২০ সালে গবেষণা খাতে দেশের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো টাকা ব্যয় করেনি। দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বয়স ২৫ বছর। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরও গবেষণা খাতে কোনো ব্যয় নেই। এভাবে দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫টি ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও বছরজুড়ে দু-চারটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য কোনো গবেষণা করেনি। ২০২০ সালে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৩৭৮। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৪৪৫।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যদি এটা হয় তবে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের অবস্থা আর বলার অবকাশ রাখে না। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো শুধু বইনির্ভর করে পড়ানো হচ্ছে। সৃজনশীল পদ্ধতি এনেও অবস্থার উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। সেখানেও রয়েছে কোচিং ও গাইড বইরে রমরমা ব্যবসা। গুটি কয়েক উদাহরণ সমাধান করেই পদার্থ, রসায়নের মতো জটিল বিষয় শেষ করে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা।

দেশের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। সর্বপ্রথম আমাদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনতে হবে। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুর ওপর কোনো বিষয় জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে তার ভালো লাগার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। সব মেধাবী যদি ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার দিকে যান তবে শিক্ষক হয়ে ভবিষ্যৎ জাতি গড়ার কাজে হাত দেবেন কে? এরপর গাইড-নোট বন্ধ করে শিক্ষার্থীকে হাতে-কলমে শিক্ষার দিকে অধিক আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল চিন্তাশক্তির অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যাতে তারা সর্বদা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে। এরপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা সংখ্যা বাড়াতে হবে। নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে যেতে হবে। নতুন নতুন বিষয়ের উদ্ভাবন, মানুষের জীবনযাত্রাকে আর সহজ করে দেওয়ার বিষয় নিয়ে কাজ করবে এই শিক্ষার্থী সমাজ। আর এটা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের আরো মনোযোগী হতে হবে। সর্বোপরি আমাদের সবার ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং চেষ্টাই পারবে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে।

লেখক : ইনস্ট্রাক্টর, হুমায়রা আইটি পার্ক, মাগুরা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close