হিমেল আহমেদ

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

বাংলা ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা

আমাদের এই গ্রহে নানা মানুষের বাস। তাদের চেহারা ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, আচার-আচরণ ভিন্ন। ভিন্ন তাদের সাংস্কৃতি ও ভাষা! মানুষের জন্য ভাষা অপরিহার্য একটি বিষয়। মনের ভাব, সংকেত আদান-প্রদানের জন্য ভাষা আবশ্যক। কিন্তু কীভাবে এলো এই ভাষা? বিশ্বে ভাষার সংখ্যা কত? বিশ্বজুড়ে ভাষার সংখ্যা আসলে কত, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা অসম্ভব। প্রতিনিয়ত অসংখ্য ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে আবার নতুন ভাষার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় সাত হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলছে। আছে অসংখ্য । বাংলা তাদের মধ্যে একটি। কথা বলার হিসাব অনুসারে বিশ্বে বাংলা ভাষার অবস্থান পঞ্চম। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বাংলা ভাষায় কথা বলে প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। বিশ্বে র সংখ্যা কত তার পূর্ণাঙ্গ জরিপ নেই। তবে বিশ্বে র জন্য আন্দোলন করে শহিদ হয়েছি আমরাই। বাংলা ভাষা ও ভাষাসংগ্রামীদের সম্মানে তাই ২১ ফেব্রুয়ারি পুরো বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

এদিকে বিভিন্ন গবেষণায় তুলনামূলক একটি চার্ট তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল তাদের ভাষা রেফারেন্স জরিপ ২০১৯ সম্পূর্ণ করেছে। সেই চার্টে দেখা গেছে, প্রায়ই দেশের ছাড়াও রয়েছে দ্বিতীয় বা ততোধিক ভাষা। জনসংখ্যা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি য় কথা বলে চাইনিজরা। তাদের প্রধান ভাষা ম্যান্ডারিন চাইনিজ ভাষা। যে ভাষায় চীনের ৭০ ভাগ মানুষ কথা বলে। এটা চীনের সরকারি ভাষা। এ ছাড়াও চীনে রয়েছে ১৩০টির মতো ভাষা এবং সংখ্যালঘু ভাষা রয়েছে ৫৫টি। চীনা ভাষা হলো কমপক্ষে ছয় হাজার বছরের ইতিহাসসহ বিশ্বের প্রাচীনতম রচিত ভাষা। চীনা চরিত্রের শিলালিপি শ্যাং রাজবংশের (১৭৬৬ খ্রিস্টপূর্ব) কচ্ছপের খোলগুলোতে পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে লিখিত ভাষা তিন হাজারে বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছে। পুরো বিশ্বে ইংরেজিকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলা হলেও চাইনিজ ম্যান্ডারিন ভাষা বিশ্বের ভাষাগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে। এ ভাষায় কথা বলে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯২ কোটি। আবারও বিশ্বে এমন কিছু ভাষা আছে; যা শুধু একজন ব্যক্তি ব্যবহার করেন!

ভাষা বড়ই বৈচিত্র্যময়। কীভাবে ভাষা এলোÑ এনিয়ে গবেষণার শেষ নেই। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বিশ্বে অনুযায়ী বাংলা রয়েছে পঞ্চম স্থানে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্প্যানিশ ভাষা! অবাক করার মতো তথ্য! ইংলিশ আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে গণ্য হলেও হিসেবে স্প্যানিশ ভাষা রয়েছে ইংরেজির আগে। স্প্যানিশকে প্রধান ভাষা হিসেবে কথা বলেÑ এমন লোকের সংখ্যা বিশ্বে প্রায় ৪৬ কোটি। মূলত স্পেন, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মানুষের স্প্যানিশ। এরপর রয়েছে ইংরেজি। হিসেবে ইংরেজিতে কথা বলেÑ এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৮ কোটি। অথচ বিশ্বজুড়ে ইংরেজিতে কথা বলছে প্রায় ১৩২ কোটি মানুষ। ইংরেজি ভাষাকে বেশির ভাগ মানুষ তাদের দ্বিতীয় কথ্য ভাষা হিসেবে রেখেছে। বাংলাদেশেও রয়েছে এ রকম চিত্র। আমদের দেশের প্রধান ও প্রথম ভাষা বাংলা হলেও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আমরা ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষা শিখে থাকি। তবে ইংরেজিকে সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা বলা হয়। ইংরেজি ভাষা হিসেবে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অনেক ক্যারিবীয় দেশে স্বীকৃত। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও অনেক আফ্রিকান দেশে ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের যেকোনো এয়ারলাইনসের প্রধান ভাষা ইংরেজি এবং একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে সহজ ভাষা হলো এই ইংরেজি! বিশ্বের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠান কিংবা দফতরের প্রধান ভাষা ইংরেজি। মর্যাদা অনুযায়ী ইংরেজির অবস্থান তৃতীয়। ইংরেজির পর চতুর্থ স্থানে রয়েছে হিন্দি ভাষা। হিন্দি মূলত ভারতেই বেশি প্রচলিত। তবে ভারত ছাড়া বাংলাদেশেও হিন্দিভাষী মানুষ রয়েছে। এ ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে হিন্দি প্রচলিত। ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৩ কোটি ৯০ লাখ কিন্তু হিন্দিকে হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় ৩৪ কোটি মানুষ। ভারতকে বিচিত্র ভাষার দেশ বলা হয়। ভারতের যতগুলো রাজ্য রয়েছে সব রাজ্যের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন! আপনি যদি কলকাতায় যান, তাহলে বুঝতেই পারবেন না এটি ভারতের অংশ! কেননা ভারতের রাজ্য কলকাতায় সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে হিসেবে বাংলার প্রচলন বেশি। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হিন্দির প্রচুর প্রভাব রয়েছে। উর্দু ও হিন্দি এই উভয় ভাষায় প্রচুর মিল পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে বিশ্বে হিন্দি চলচ্চিত্র, নাটক ও গানের প্রচলন খুব বেশি হওয়ায় হিন্দি ভাষা উর্দুর চেয়ে অধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ছাড়াও ভারতে মাড়াঠি, তেলেগু, তামিল, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ইংরেজি, উর্দুতে হিসেবে প্রচুর মানুষ কথা বলে। শুধু ভারতেই বাংলা ভাষায় কথা বলে প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। তার সিংহভাগই হলো কলকাতার বাসিন্দা। বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এর পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি। তাই অনুযায়ী বাংলা রয়েছে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে।

ভাষা নিঃসন্দেহে একটি জাতির প্রাণস্বরূপ। লাখো শহিদের রক্তে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকামী মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছে প্রতিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে। বলা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপণ হয়েছিল ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে। ৫২ না পেলে ৭১ পেতাম না। ১৯৫১-এর একুশ এসেছিল বাংলার নির্যাতিত মানুষের মুক্তির পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা হিসেবেই। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাই পূর্ব পাকিস্তান সরকারে প্রাধান্য পায়। পাকিস্তান সরকার ঠিক করে উর্দুভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করা হবে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল খুবই কম। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এই সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। সেই থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। পাকিস্তান সরকার ভীত হয়ে ভাষার এই আন্দোলন বন্ধ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ও আরো কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে একটি মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে এলে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন আবদুস সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ও তীব্র আকার ধারণ করে।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শহিদদের মর্যাদা আর স্মরণে ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করে। তাই বাংলাকে ছোট করে দেখার কিছুই নেই। বাংলা ভাষার পর ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে পর্তুগিজ ভাষা। হিসেবে পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলে বিশ্বে প্রায় ২২ কোটি মানুষ। এরপর রয়েছে রাশিয়ান । যে ভাষায় কথা বলে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি মানুষ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ান ভাষা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। রাশিয়া ছাড়াও পুরো বিশ্বে রাশিয়ান ভাষাকে হিসেবে ব্যবহার করছে প্রায় ৩১ দেশ। আর্মেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, ইসরায়েল, ফিনল্যান্ড, কানাডা, সাইবেরিয়াসহ আরো অনেক। বিশ্বে জাপানিজ ভাষাকে দুর্বোধ্য ভাষা বলা হয়। হিসেবে জাপানিজ ভাষায় কথা বলে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ। তাই অনুযায়ী জাপানিজ ভাষার স্থান অষ্টম। জাপানিজ ভাষা মূলত জাপানেই অধিক প্রচলিত। চীনাদের সঙ্গে জাপানিজদের তেমন কোনো জেনেটিক সম্পর্ক নেই, তবে লেখার দিক দিয়ে অনেক ভাষা চীনাদের কাছ থেকেই নেওয়া। এ ছাড়া কিছুটা আরবি ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। নবম ও দশম ও রয়েছে ভারতের দখলে। পাঞ্জাবি ও মারাটি ভাষা বিশ্বের শীর্ষ ১০টির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। হিসেবে পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে প্রায় ৯ কোটি ২৭ লাখ মানুষ এবং মারাঠি ভাষায় কথা বলে প্রায় ৮ কোটি ৩০ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রের এসআইএল ইন্টারন্যাশনাল অনুযায়ী বিরাট বড় একটি তালিকা তৈরি করেছে। তবে বেশ কিছু ভাষা রয়েছে, যেগুলোকে কোনো র?্যাংক বা নাম্বার অনুসারে তালিকাবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close