গাজী শাহনেওয়াজ

  ২১ নভেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্ব সংকট, উপর্যুপরি দুর্যোগের ভয়াবহ আঘাত, জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি এবং সম্পদের অমিতাচারী ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে আনা ‘গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার সাধারণ প্রস্তাব জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। চলতি সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭(১) বিধি অনুসারে সরকারি দলের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ওই সাধারণ প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে আলোচনা শেষে কণ্ঠভোটে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। জলবায়ু নিয়ে বাংলাদেশের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ যারা গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করল। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন লক্ষ্য অর্জনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) ২০১০ সালে কানকুন অ্যাডাপ্টেশন ফ্রেমওয়ার্কের (সিএএফ) আওতায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) প্রবর্তন করেছিল। এটি ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচিতে সহায়তা প্রদান করা।

এরপর ২০১১ সালেডার্বানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা ন্যাপ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তারপর প্যারিস চুক্তিতে টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখার লক্ষ্যে এবং তাপমাত্রা লক্ষ্যমাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত অভিযোজন প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে একটি বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ

করা হয়। যেখানে অভিযোজিত ক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা জোরদার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিযোজন পরিকল্পনার ওপর আরো বেশি জোর দেওয়া হয়।

প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে দায়ী শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোর আগ্রহের অভাব রয়েছে। এমনকি ১৯৯২ সালের গৃহীত জাতিসংঘ জলবায়ু সনদ শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোর অনেকেই মানছে না। ফলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ঘন ঘন আঘাত হানছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে। সর্বশেষ চলতি মাসেই ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ বাংলাদেশ ও ভারতে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের জলবায়ুর অভিঘাতে জাতীয় আয়ের দু-তিন শতাংশ প্রতি বছর তলিয়ে যাচ্ছে। দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। যে কারণে অভিযোজনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন কেমন হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোজন এখনো সঠিকভাবে পরিমাপ করা কঠিন। অভিযোজন বিজ্ঞান এ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনের তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করেছে।

প্রথমটি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলো মূল্যায়ন ও যাচাই করা। ইতোমধ্যে আমরা কাজটি শুরু করেছি। আর অভিযোজনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এখন দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগুলোতে বিনিয়োগ যেমনÑ সেতু, রাস্তা, বিমানবন্দর এবং নৌ-বন্দরগুলোর বিষয় বিবেচনা করা। যাতে সেগুলো ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহিষ্ণু হয়। এখন সারা বিশ্বে সব বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। অভিযোজনের তৃতীয় বা সর্বশেষ পর্যায়টিকে রূপান্তরমূলক অভিযোজন বলা হয়। যা এখনো কিছুটা তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে। যা কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা নয়, বরং অভিযোজন ব্যবস্থার ভালো ফল লাভের জন্যও প্রযোজ্য।

নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরিও করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) তৈরি করা হয়। ২০০৯ সালে তা সংশোধিত হয়। বাংলাদেশ প্রথম দেশ, যে এটি করেছে। ১০ বছর পর এখন এটি জন অংশগ্রহণের ভিত্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। আর জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় পরিবেশগত ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল (সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চল প্রভৃতি) ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের বিপদাপন্নতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। খসড়া ন্যাপ প্রস্তাবনায় দুটি পৃথক ইকোসিস্টেমে পরীক্ষামূলকভাবে এলাকাভিত্তিক স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ থাকলেও প্রকল্প প্রস্তাবনায় তার উল্লেখ নেই। অথচ নেপালের স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের অভিজ্ঞতাকে বাংলাদেশে কাজে লাগিয়ে অভিযোজন বিষয়ে একটি অগ্রগামিতা সৃষ্টি করা সম্ভব।

এমতাবস্থায় অবিলম্বে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা চূড়ান্ত ও তা বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের লক্ষ্যে বেশ কিছুটা এগিয়েছে। অভিযোজনকে আরো কার্যকর করতে ইতোমধ্যে কিছু শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রথম শিক্ষাটি হচ্ছে সত্যিকারের রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের জন্য এক দশক বা তারও বেশি সময় লাগবে। অতএব স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রকল্পভিত্তিক বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযুক্ত হবে না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় রূপান্তরমূলক অভিযোজনে সহায়তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিভিত্তিক জাতীয় কর্মসূচিতে অর্থায়ন করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা কেবল একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নয়। এটা লাখ লাখ নিরীহ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা জীবন ও জীবন রক্ষার কর্মপরিকল্পনা হওয়া উচিত। ন্যাপের বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, অংশগ্রহণ, অখন্ডতা, ন্যায়সংগত এবং সংহতি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের জন্য আইনত বাধ্যতামূলক নথি হওয়া উচিত। আর এজন্য অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচিগুলো প্রণয়ন ও পরিচালনার জন্য দক্ষতা এবং সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি প্রয়োজন। জরুরিভিত্তিতে দ্রুপদী গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমফিল ও পিএইচডি কর্মসূচি অতিসত্বর চালু করা দরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতো, অভিযোজন পরিকল্পনায় সরকার ও সরকারের বাইরে বিশেষ করে বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সম্পৃক্ত করতে হবে। অর্থাৎ কেবল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে সরে আসা। প্রকৃত রূপান্তরমূলক যেকোনো পরিবর্তনে অবশ্যই প্রতিটি দেশের সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মাত্রা দেশজুড়ে হতে হবে। কোনো ছোট অঞ্চলে বা খাতে সীমাবদ্ধ থাকলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। তাই দেশে শুধু জাতীয় পর্যায়ে রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করতে হবে।

নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, বাংলাদেশের (এনসিসিবি) পক্ষ থেকে ইকোসিস্টেমভিত্তিক স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনার ভিত্তিতে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গণ-অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। দেশের প্রধান ছয়টি ইকোসিস্টেমের (খরাপ্রবণ অঞ্চল, উপকূল অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, বন্যা প্লাবন ভূমি, চরাঞ্চল ও হাওর এলাকা) জন্য ইকোসিস্টেমভিত্তিক স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের হাত থেকে বিপন্ন মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় অভিযোজনের বাইরে লস অ্যান্ড ড্যামেজ মোকাবিলার একটি জাতীয় কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। ন্যাপ প্রকল্প প্রণয়নে প্রস্তাবিত কারিগরি উপদেষ্টা বোর্ডে জাতীয় পর্যায়ে কর্মরত এনজিও ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটিতে ১০ শতাংশ আসন এনজিও ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ওইসব দাবিনামা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সঠিক অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব। আর সেই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন করে অভিযোজন অর্জনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি থেকে বাংলাদেশ সর্বাধিক সহিষ্ণু দেশে রূপান্তরিত হতে পারে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের মতো বাংলাদেশ তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনেও সামনের কাতারে চলে আসতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে নেতৃত্ব দিতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close