রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যালোচনা

ব্রেক্সিট নিয়ে চরম সংকটে ব্রিটেন

ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে বহু দিন ধরে ভুগছে ব্রিটিশ রাজনীতি। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোটের পরপরই পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তারপর ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে আসেন থেরেসা মে। কিন্তু পার্লামেন্ট তার প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট চুক্তিতে সম্মত না হওয়ায় তিনিও পদত্যাগ করেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে পরপর দুবার ব্রেক্সিট কার্যকরের সময়সীমা পেছান তিনি। মের পর প্রধানমন্ত্রী ও কনজারভেটিভ দলের নেতা নির্বাচিত হন জনসন। ক্ষমতায় এসেই ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট সম্পাদনের প্রত্যয় ঘোষণা করেন। হোক তা চুক্তিসহ বা চুক্তি ছাড়া।

ব্রিটিশ রাজনীতিতে নাটকীয়তার অন্ত নেই যেন। একের পর এক হতবাক করা সব ঘটনা ঘটে চলেছে দেশটিতে গত দুই সপ্তাহে, তা আগের সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, এক দিনের মধ্যে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। বিদ্রোহ করেছেন সরকারদলীয় ২১ সংসদ সদস্য। আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষে দ্বিতীয় দিনের মতো পার্লামেন্ট বসে। প্রথম দিনের অধিবেশনে বড় ধরনের পরাজয়ের স্বীকার হয়েছেন জনসন। তার নিজ দলের ২১ এমপি বহিষ্কারের হুমকি উপেক্ষা করে সরকারবিরোধী একটি বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিরোধী ও বিদ্রোহী সংসদ সদস্যদের হাতে। সেখানে ব্রেক্সিট কার্যকরের সময়সীমা পেছাতে একটি বিল উত্থাপন করার কথা রয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায়, বহিষ্কারের হুমকি উপেক্ষা করে কনজারভেটিভ পার্টির ২১ জন এমপি জনসন সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক কয়েকজন মন্ত্রীও।

এমনকি চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তারা। এর ফলে পার্লামেন্টে ৩২৮-৩০১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছে সরকার। এ ভোটের ফলে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ এখন ‘চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বিরোধীদের’ হাতে। এর অর্থ হলো ব্রেক্সিট সম্পাদনের সময়সীমা বিলম্বিত করতে পার্লামেন্টে বিল আনতে পারবেন তারা। এই বিলে তারা ব্রেক্সিট সম্পাদনের সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়াতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম। যদি তাই হয় তাহলে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের সম্ভাবনা থাকবে না। এমতাবস্থায় ব্রেক্সিট নিয়ে সংশয় থেকে বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়েছেন তারই ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভের ২১ এমপি। এর এক দিনের মাথায় তাদের বহিষ্কার করেন জনসন। ফলস্বরূপ, তারা এখন পার্লামেন্টে স্বাধীন সংসদ সদস্য হিসেবে যোগ দেবেন। এদিকে, অধিবেশনের আগ দিয়ে জ্যেষ্ঠ কনজারভেটিভ নেতা দলত্যাগ করে লিবারেল ডেমোক্রেটদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ফলে অধিবেশন শুরুর আগেই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় তার দল। পার্লামেন্টে দেওয়া এক ভাষণে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের প্রতি আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব তোলেন জনসন। তিনি চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে বিরোধীদলীয় জোটের বিলটিকে আত্মসমর্পণ বিল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বলেন, আত্মসমর্পণ বিলটি পাস হলে বিরোধী দলের নেতা কি ১৫ আগস্ট একটি নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে এই দেশের জনগণকে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেবেন? তবে জনসনের প্রস্তাবে সাড়া দেননি করবিন।

সম্প্রতি পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণা দেন জনসন। এতে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় বিরোধীদের মনে। তারা অভিযোগ করে, পাঁচ সপ্তাহ পার্লামেন্ট বন্ধ থাকলে ব্রেক্সিট নিয়ে পার্লামেন্টে কোনো চুক্তি পাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। জনসনের ঘোষণা অনুযায়ী, স্থগিতাবস্থা শেষে ১৪ অক্টোবর নতুন অধিবেশন শুরু হবে পার্লামেন্টে। তখন ব্রেক্সিট সম্পাদনের জন্য সময় থাকবে মাত্র দুই সপ্তাহ। এদিকে, পার্লামেন্টে জনসন ফের নিশ্চিত করেন যে, তিনি ৩১ অক্টোবর ইইউ থেকে বের হয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রয়োজনে কোনো চুক্তি ছাড়াই। এমতাবস্থায় তিনি বলেছেন, অক্টোবরে নির্বাচনের প্রচেষ্টা চালানো ছাড়া তার কিছু করার নেই। কারণ তিনি বলছেন, দেশের জনগণকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদিও এটিও তার জন্য খুব সহজ হবে না। কারণ ব্রিটেনে ২০১১ সালের একটি আইনে পার্লামেন্টকে পাঁচ বছরের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে। এখন সেটি পরিবর্তন করতে হলে সংসদে বরিস জনসনের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগবে। তা পেতে হলে তার বিরোধী দল লেবার পার্টির সমর্থন দরকার হবে। সেই সমর্থন পাওয়া জনসনের জন্য খুব একটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) বিষয়ে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও দেশবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাজ্যের সরকার। গত সপ্তাহে দেশটির ব্রেক্সিট-বিষয়ক মন্ত্রী ডোমিনিক রাব এক বক্তৃতায় চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিটের সম্ভাব্য সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে তিনি ওইসব সমস্যা মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রস্তুতির বিষয়েও পরামর্শ দেন।

তাছাড়া দিকনির্দেশনামূলক ২৫টি আলাদা দলিল প্রকাশ করে মন্ত্রী ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, গবেষকসহ বিভিন্ন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্ভাব্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। ডোমিনিক রাব বলেন, কল্যাণকর একটি চুক্তিই সরকারের প্রত্যাশা। তবে উভয় পক্ষ চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে স্বল্পমেয়াদে যে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, সেসব বিষয়ে প্রস্তুতি রাখার জন্য সরকার এসব নির্দেশিকা প্রকাশ করছে। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার কথা। ভবিষ্যৎ বাণিজ্য ও অন্যান্য সম্পর্ক নিয়ে চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হলে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে পণ্য ও সেবার স্বাভাবিক আদান-প্রদান ব্যাহত হবে। এ বিষয়ে সম্ভাব্য প্রস্তুতির বিষয়ে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য করণীয় বাতলে দিয়েছে সরকার। এতে বলা হয়েছে, চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট হলে ইইউভুক্ত দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে পণ্যের ঘোষণা (কাস্টমস ডিক্লারেশন) দিতে হবে, সম্ভাব্য আমদানি বা রফতানি শুল্ক (ট্যারিফ) দিতে হতে পারে। এসব কাজ সম্পাদনে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, স্বল্পমেয়াদে বাণিজ্য খরচ বাড়বে। তবে ইইউ–বহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার কোনো কোনো খাতের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বিলম্বে সংগ্রহের বিষয়টি ভাবছে বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়। এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ব্যবসায়ী মহল।

অপরদিকে বিবিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট হলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে যুক্তরাজ্যের কৃষি খাত। ইইউয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের কৃষিপণ্যের আদান-প্রদান হয়ে থাকে। ইইউয়ের অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ এসব পণ্যের মান নির্ধারণ করে। ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যকে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। ওই কর্তৃপক্ষকে আবার ইইউয়ের স্বীকৃতি পেতে হবে। অন্যথায় ব্রিটিশ পণ্য ইই য়ের দেশগুলোতে বিক্রি অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় এক মাস আগে থেকেই ইই য়ের সদস্য দেশগুলোর জন্য চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তারা কিছু নির্দেশনা প্রকাশ করে। ইইউ বলছে, যুক্তরাজ্য যেসব সম্ভাব্য সমস্যা ও প্রস্তুতির কথা বলছে, সেগুলো ব্রেক্সিটের অবধারিত প্রভাব। তাছাড়া সদস্য দেশগুলোকে পাঠানো ইইউয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যকে সদস্যবহির্ভূত দেশ হিসেবে (থার্ড কান্ট্রি) বিবেচনা করতে আইনগতভাবে বাধ্য ইইউ। ফলে যুক্তরাজ্যের জন্য ইইউ আইনের কোনো শিথিলতা প্রদান আইনি কারণেই সম্ভব হবে না। সম্প্রতি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট নিয়ে এক ভোটাভুটিতে হেরে গেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এর ফলে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিল চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিটের বিরোধী এমপিরা। এখন তাদের জন্য চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট ঠেকাতে আরো একটি বিল আনার সুযোগও তৈরি হলো। তবে ভোটাভুটিতে হেরে যাওয়ার পর বরিস জনসন বলেছেন, তিনি আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব আনবেন। আগামী ৩১ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ, যেটি ব্রেক্সিট হিসেবে পরিচিত তা কার্যকর হওয়ার কথা। কীভাবে, কোন চুক্তিতে সেই বিচ্ছেদ হবে, এ নিয়েই চলছে এখন আলোচনা।

ব্রিটেনে ২০১১ সালের একটি আইনে পার্লামেন্টকে পাঁচ বছরের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে। এখন সেটি পরিবর্তন করতে হলে সংসদে বরিস জনসনের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগবে। এটি পেতে হলে তার বিরোধী দল লেবার পার্টির সমর্থন দরকার হবে। সেটি জনসনের জন্য খুব একটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি ভোটের ফলের কারণে আজ এমপিরা হাউস অব কমন্স নিয়ন্ত্রণ করবেন। এর ফলে তারা ব্রেক্সিট ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিলম্বিত করার প্রস্তাব দিতে প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করতে বিল আনার সুযোগ পাবেন। তবে সেটি তখনি ঘটবে, যদি এমপিরা ১৯ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিটের জন্য একটি নতুন চুক্তি অনুমোদন বা চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট না দেন। ধারণা করা হচ্ছে, সরকার ১৫ অক্টোবর একটি সাধারণ নির্বাচন করতে চান। তার দুদিন পরেই ব্রাসেলসে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্যদিকে লেবার নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিটের পক্ষে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর নেই। তিনি মন্তব্য করেন, ভোটাভুটি হওয়ার আগেই এই বিল পাস হওয়া উচিত ছিল। এখন পর্যন্ত ২১ জন টোরি এমপি, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীও রয়েছেন, তারা সরকারকে হারাতে বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তবে বিরোধীদের এখন দাবি, ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ যেন না হয়, সেটি আগে নিশ্চিত করা, তারপর যত দ্রুত সম্ভব সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি। তবে ব্রেক্সিটে বাতিল করারও আইনি উপায় রয়েছে। এজন্য শুধু সরকারকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে পাঠানো আর্টিকেল ৫০ প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তবে এটা পরিষ্কার যে, বর্তমান সরকার সে রকম কিছু করছে না।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close