আর কে চৌধুরী

  ২৫ জুন, ২০১৯

মতামত

মানব পাচার বন্ধ হোক

মানব পাচারের উর্বর ভূমি হিসেবে যেসব দেশকে ভাবা হয়, বাংলাদেশের স্থান তার ওপরের দিকে। মানব পাচারের লজ্জা থেকে বাঁচতে ২০১২ সালে মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হলেও তা বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোয় পরিণত হয়েছে। এ আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও গত সাত বছরে তা হয়নি। ট্রাইব্যুনাল গঠিত না হওয়ায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুসারে প্রতিটি জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচারের মামলার বিচার চলছে। এর ফলে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময়ই পিপিরা মানব পাচার মামলার শুনানিতে আগ্রহ কম দেখান। সাক্ষী হাজির করতেও তারা গাফিলতি করেন। এ কারণে একদিকে যেমন মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা হয়, তেমনি আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় ৪ হাজার ১৭৭টি মামলার মধ্যে ৩০৪টি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৪৮, মানিকগঞ্জে ৬, নরসিংদীতে ১৯৮, জয়পুরহাটে ১, খুলনায় ৫, যশোরে ২৭, সাতক্ষীরায় ৫, চুয়াডাঙ্গায় ১, নড়াইলে ৫, মেহেরপুরে ১, বরগুনায় ৪ ও সিলেটে ৩টি মামলা পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। পাচারের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া আছে মিয়ানমার। দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে দেড় লাখ মানুষ পাচারের শিকার হয়।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার তথ্যানুযায়ী গত আট বছরে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানব পাচারের শিকার হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত দেড় হাজার মানুষ মারা গেছে। মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত অপরাধী চক্র পাচারের শিকার ব্যক্তিদের বিদেশে আটক করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণও আদায় করে অনেক সময়। মানব পাচার দেশের ভাবমূর্তি এবং হাজার হাজার মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে। গত সাত বছরে এ-সংক্রান্ত মামলার মাত্র ৫ শতাংশের নিষ্পত্তি হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তের সংখ্যাও নগণ্য। পাচার বন্ধে এ-সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন যেমন জরুরি তেমনি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কড়া মনোভাব থাকতে হবে; যা এখন সময়েরই দাবি।

দুনিয়ার যেসব দেশ থেকে মানব পাচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশের স্থান সে তালিকায় প্রথম কাতারে। প্রতি বছর এ দেশ থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ পাচার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। পাচারকারীদের লোভনীয় চাকরির ফাঁদে পা দিয়ে বিপুলসংখ্যক নারী বিদেশে পাচার হওয়ার পর ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। লোভনীয় চাকরির নামে বিদেশে পাঠিয়ে যুবকদের দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

অভিবাসীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত ভূমধ্যসাগর। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে ২০০০ সাল থেকে এখন অবধি ৩৩ হাজার মানুষ মারা গেছে বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধ পথে ইউরোপে ঢোকার উদ্দেশে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশিদের সতর্ক করেছে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস। শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয় বাংলাদেশিদের। সম্প্রতি লিবিয়া উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পথে অনেক বাংলাদেশি নিহত হন। আরেকটি নৌকায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ৭৫ নাগরিক ইউরোপের পথে যাত্রার চেষ্টা করেছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে যাত্রার সময়ে অকালে প্রাণ দিয়েছেন অনেকেই। উল্লেখ্য, ২০১৮ সাল থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে অভিবাসনের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই লিবিয়ার বাংলাদেশস্থ দূতাবাস বাংলাদেশিদের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে। অবৈধভাবে দালালের মাধ্যমে বিদেশে যেতে চাইলে, বিদেশে কাজের সন্ধান দেওয়া তো দূরের কথা, টাকা হাতিয়ে নিয়ে মাঝপথেই পালিয়ে যায় প্রতারকরা। বিনা টাকায় অথবা কম টাকায় বিদেশে পাঠানো হবে, এ ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে থাকে পাচারকারীরা। ইতোমধ্যে জাল পাসপোর্ট, অবৈধ বা বুয়া কাগজপত্রসহ বিদেশে ধরা পড়ে জেল-জরিমানার শিকার হয়েছেন অনেকেই। এসব কারণে জায়গা-জমি বিক্রি করে দেওয়া টাকা, উচ্চ সুদে ঋণের টাকা জলাঞ্জলি দিয়ে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কেবল ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। এটা সত্য, অবৈধ উপায়ে বিদেশ গমন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে।

এটা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে যদি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকত, তা হলে এভাবে মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যাওয়া লাগত না। আমরা চাই সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক। সরকার যদি ব্যাপকভাবে শিল্পায়নের দিকে বিশেষ নজর দেয়; তা হলে অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে। পাশাপাশি যেসব দালাল ও অপরাধী এর সঙ্গে যুক্ত তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন আগের ঘটনায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে যারা মারা গেছে তারা প্রত্যেকে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা দালালদের দিয়েছে। এই বিপুল অঙ্কের টাকা হয় ফসলি জমি ভিটাবাড়ি বিক্রি করে, না হয় ঋণ করে জোগাড় করেছিল। ওই পরিবার এখন নিঃস্ব সর্বস্বান্ত শোকগ্রস্ত। একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পুরো পরিবার পথে বসে গেল। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির শিকার হয়ে একটি স্বপ্নের সম্ভাবনার অকালমৃত্যু হলো। এর দায় কে নেবে?

সাম্প্রতিক সময়ে মানব পাচার চক্রের চোখ পড়েছে আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া এবং মৌরিতানিয়ার দিকে। চক্রের খপ্পরে পড়া নরনারীদের সেখান থেকে সাগরপথে পাচার করা হচ্ছে ইউরোপের স্পেন ও ইতালিতে। এর বাইরে মানব পাচারের জন্য চক্রের পছন্দে রয়েছে ইউরো-এশিয়ান দেশ জর্জিয়া, তুরস্ক, এশীয় দেশ ইরান এবং আফ্রিকান দেশ লিবিয়া। মানব পাচারে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করছে কয়েকটি এয়ারলাইনসের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এয়ার অ্যারাবিয়া, মালিন্দ এবং ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইনসের কোনো কোনো অসৎ কর্মকর্তা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের কিছু লোককে হাত করে নেয়। তারাই বলে দেয় কোনো কাউন্টার দিয়ে পাচারের লোকদের ঢোকানো হবে।

চক্রটি ই-ভিসার সুবিধায় ইউরোপে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের প্রথমে জর্জিয়া পাঠায়। এরপর তাদের তুরস্ক হয়ে ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পাঠানোর জোর চেষ্টা চালায়। বিকল্প হিসেবে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সব কিছুই হয় চুক্তির ভিত্তিতে।

বাংলাদেশি দালাল চক্রের সঙ্গে তুরস্ক ও জর্জিয়ার কিছু নাগরিক জড়িত। প্রতি বছর বিদেশে পাচারের সময় বিপুলসংখ্যক নর-নারীকে উদ্ধার করা হলেও জনসচেতনতার অভাবে পাচারের ঘটনা কমছে না। বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে মানব পাচারের ফলে উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দিতে দ্বিধায় ভোগে। দেশের সুনামের স্বার্থে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close